প্রতিনিধি( কয়রা) খুলনাঃ জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশের প্রতিবাদে খুলনার কয়রায় বিক্ষোভ মিছিলে গুলি করে দলটির এক কর্মীকে হত্যার অভিযোগে ১২ বছর পর মামলা হয়েছে। ১৭ এপ্রিল ১১৩ জনকে আসামি করে কয়রার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি করা হয়। মামলার বাদী গুলিতে নিহত জামায়াত কর্মী জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী ছবিরন নেছা। তবে বাদী বলছেন, মামলায় আসামি কারা সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। তার দাবি, তাকে কাগজে স্বাক্ষর দিতে বললে তিনি স্বাক্ষর দেন। মামলার বিষয়ে তাকে কিছু বলা হয়নি।
মামলার বাদী ছবিরন নেছার বাড়ি কয়রা উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামে। রবিবার সকালে ছবিরন নেছার বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর সাথে। তিনি বলেন, মামলা করার ওইদিন আমাকে ফোন করে কয়রা উপজেলা সদরে ডেকে নেন জামায়াতের নেতা মিজান ভাই আর গোলাম রব্বানী। গোলাম রব্বানীও জামায়াত নেতাদের সাথে চলাফেরা করেন। একারণে ভেবেছি দলের সিদ্ধান্তেই মনে হয় আমাকে ডাকছে। আমি কয়রা আদালতে পৌঁছে দেখি কয়রা সদর ইউনিয়ন জামায়াতের আমীর মিজান ভাই আর উকিলরা সেখানে আছে। উকিলদের আমি চিনিনা। মামলার কাগজ আমাকে তাঁরা পড়তেও দেয়নি। আমি শুধু স্বাক্ষর করেছি। উকিলদের কারা ডেকেছে তাও আমি জানিনা।
আদালতে দাড়িয়ে বিচারক মামলায় কয়জন আসামি জানতে চাইলে তা তিনি বলতে পারেননি জানিয়ে ছবিরন নেছা বলেন, আমিতো মামলা সম্পর্কে কিছুই জানিনে, কি উত্তর দেব! বিচারক পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন -মামলার প্রথম নম্বর আসামির নাম বলেন? আমিতো সেটাও জানিনে। তাই বলতেও পারিনি।
মামলার আরজিতে বলা হয়েছে, জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের উদ্যোগে কয়রা সদরে মিছিল হয়। সেটি প্রতিহত করতে তখন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বে হামলা হয়। হামলায় অন্তত ৩১ জন আহত হন। তাঁদের মধ্যে বাদীর স্বামী জাহিদুল ইসলাম ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
তবে মামলার বাদী ছবিরনের দাবি, ঘটনার দিন সন্ধায় তিনি খবর পেয়েছিলেন স্বামী গুলিতে মারা গিয়েছেন। কিন্তু তিনি ঘটনাস্থলে তখন মারা যাননি। গুলিবিদ্ধ আহত হয়ে কয়েকমাস চিকিৎসা নিয়ে তারপর মারা গেছেন। তখনকার সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন।
ছবিরন বলেন, মামলা হওয়ার পর ভাবলাম স্বামী হত্যার বিচার পাব। তবেএখন শুনছি অনেক নিরপরাধ মানুষও মামলায় আসামি হয়েছে। আমিতো কারো নাম দেইনি। মামলাটা আমি ব্যক্তিগতভাবে করলে আমার ভাইদের সাথে আলাপ করতাম। আমার আশেপাশের যারা আছেন তাদের জানিয়ে করতাম, এমন ঝামেলা হতো না। এই মামলার মূল হোতা গোলাম রব্বানী। আমি চাই দোষীদের বিচার হোক, অহেতুক কোনো নিরপরাধ মানুষ যেন হয়রানি না হয়।
ছবিরন নেছার মুঠোফোন থেকে তাঁকে মামলা করতে ডাকা ফোন নাম্বার নিয়ে দেখা যায় সেটি কয়রা উপজেলা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবায়ক গোলাম রব্বানীর।
এ বিষয় জানতে গোলাম রব্বানীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁর নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
নিহত জামায়াত কর্মী জাহিদুল ইসলামের চাচাতো ভাই কয়রার নারায়নপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. বাবুল আক্তার বলেন, ছবিরন নেছা সম্পর্কে আমার বোন হয়। আমার ভাই মারা যাওয়ায় পর থেকে ওদের পরিবারের সকল বিষয়ে জামায়াত দলীয়ভাবে সহোযোগিতা করে। মামলা করার দিন জামায়াত নেতারা দলীয়ভাবে ডাকছে ভেবে বোনটা গিয়েছিল। মামলার পর পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা এসেছিলেন আমাদের এখানে। আমরা বলেছি মামলায় নির্দোষ কেউ যেন হয়রানি না হয়।
বাদী ছবিরন নেছার ভাই মো. উজ্জ্বল হোসেন বলেন, যিনি মারা গেছেন, মামলা করলেতো আর তিনি ফিরে আসবেন না। এজন্য আমরা মামলা করতে চাইনে। রাজনীতির লোকজন মামলা করতে ছবিরনকে ডেকে নিয়ে এখন অস্বীকার করছেন। তবে আমাদের মোবাইলে কারা ফোন করে মামলা করতে ডেকেছিলেন তাদের কল রেকর্ড আছে।
জানতে চাইলে জামায়াতের কয়রা সদর ইউনিয়নের আমীর মিজানুর রহমান বলেন, মামলার আসামি তালিকার ৪৯ নম্বরে আবু হুরায়রা খোকন নামে আমাদের দলের এক কর্মীর নাম দেয়া হয়েছে এই সংবাদ শুনে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। আমি শুধু ওই নামটা কেটে দিয়ে আসি। এর বাইরে মামলা সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই।
খুলনা জেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা এমরান হুসাইন বলেন, কয়রার মামলার ঘটনাটি আমাদের সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে হয়নি। বাদী অন্য কারোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মামলাটি করতে পারেন। তারপরও মামলার পেছনে আমাদের সংগঠনের কেউ জড়িত আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নিরীহ কেউ যেন মামলার মাধ্যমে হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামী সবসময় সোচ্চার রয়েছে।
মামলার আইনজীবী মো. শামীমুল ইসলামের নিকট মামলার আইনজীবী ও আসামিদের বাদী চিনতে না পারার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মুঠোফোনে প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাদী উকিলকে চেনা কিংবা না চেনা এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে বাদী আসামিদের চেনেন, তাঁর জবানবন্দি অনুযায়ী মামলায় আসামি করা হয়েছে। ওই মামলায় রাজনৈতিক দলের হাইকমান্ডের ফোন আছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন সহায়তা প্রদানকারী সংস্থার কয়রা উপজেলা শাখার সভাপতি আইনজীবী আবু বকর সিদ্দিক বলেন, আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে কয়রা থানায় নথিভুক্ত করতে আদেশ দিয়েছেন। অথচ বাদী আসামিদের চেনেন না। এ মামলায় কয়রায় কর্মরত কয়েকজন সংবাদকর্মী ও বেশ কিছু নিরীহ মানুষকে উদ্যেশ্য প্রণোদিতভাবে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ও হয়রানি এড়াতে পরিবার ফেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। আমরা সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে নিরপরাধ মানুষদের এসব হয়রানিমূলক মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
Leave a Reply