মানব জীবনের সুখের প্রহর যদি আবেশে হারিয়ে যায়, তবে উপভোগের বিলাসিতা আনন্দের মাঝে বিলীন হয়। কিছু আনন্দের মুহূর্ত লিখে তার প্রকাশ করা যায়, আবার অনেক সময় প্রকাশ করাও যায় না। মুসলিম উম্মাহর শান্তি, কল্যাণ ও সৌভাগ্যের বার্তা নিয়ে মাহে রমজানের পরে আসে ঈদ। আর এই ঈদের আনন্দ নিয়ে যুগে যুগে রচিত হয়েছে অজস্র কবিতা, গল্প, কথিকাসহ অনেক উপভোগ্য বিষয়াবলী। বর্তমান সময়ের লেখকদের রচনায়ও উঠে আসে ঈদের নানা স্মৃতিকথা। উঠে আসে ধনি-গরিব নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের নানান রকমের গল্পকথা। বিশেষ করে আমরা যারা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আজ বড় হয়েছি, আমাদের কাছে ছেলেবেলার ঈদের আনন্দ এখনও মহা এক সুখ বিলাসের স্মৃতি। সেই স্মৃতি মোটেও ভোলার মতো নয়। ছোটবেলার সেই নির্মল আর নিষ্কলুষ আনন্দ আমরা খুঁজে ফিরি আনাচে কানাচে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বর্তমান সময়ের ছেলেমেয়েরা কি আমাদের মত ঈদের আনন্দ কাটাতে পারছে? এর উত্তর আমাদের আশেপাশের শিশুদের দিকে তাকালেই মনে হয় আন্দাজ করা যায়। তারা আধুনিকতার ছোঁয়ায় উন্নত জীবনযাপনের ফলে ঈদে শুধু পোশাক-আশাকের মধ্যেই আনন্দ খোঁজে। যার ফলশ্রুতিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবাদের পকেটে টাকা থাক বা না থাক, পড়নের শার্ট লুঙ্গি ছেঁড়া, নিজের কেনার সামর্থ্য থাক বা না থাক, ধারদেনা করে হলেও চেষ্টা করেন নতুন পোশাকে ছেলে-মেয়েদের রাঙাতে। উচ্চবিত্তদের তো কথাই নেই! তারা বিদেশে যান শপিং করতে। তাতে বোঝা যায় ঈদ বলতে যেন শুধুই নতুন পোশাক কেনা। আর এ ধারণা শুধু আমাদের ছোটো ছেলে-মেয়েদের নয় বরং বড়দেরও। দেখা যায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ঈদ এলেই নিজের কিংবা পরিবারের সামর্থ্যের দিকে লক্ষ্য না রেখে সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায়। আর তা না পেরে উঠলে তারা নিজেদের খুব হীন মনে করে। মূলতঃ বর্তমানে পোশাক-পরিচ্ছদই যেন নিজেকে সেলিব্রিটি কিংবা মোহনীয়তা প্রকাশের একটা প্রবণতা সবার মাঝে। যা আমাদের সময় ছিল বাহুল্যই বটে। তবে এখনকার ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকালে মনে হয়, আমাদের শৈশব অনেক আনন্দেই কেটেছে। যদি ঈদ উপলক্ষ্যে আমাদের একটা লুঙ্গি বা শার্ট অথবা একজোড়া স্যান্ডেল পাওয়া যেতো, আর হাতে কয়টি টাকা! তাহলে তা হতো যেন সোনার হরিণ, সুখের অন্যতম উপলক্ষ্য। আমাদের সময়কালে আনন্দের সীমা কী খুব বেশি ছিল? উৎসবের নানা উপাদান কি ছিল? বলতে গেলে ওই সময় সেরকম কিছুই ছিল না। ছিল শুধু সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি এবং অল্পে তুষ্ট থাকবার মানসিকতা, সাথে স্বচ্ছ সুন্দর মানসিকতা, যা মহান সৃষ্টিকর্তার অসীম নেয়ামত।
আমার ছেলেবেলায় দেখেছি, যারা রোজা রাখতো তাদের আনন্দ এবং আন্তরিকতার ধারাই ছিলো আলাদা, সেই অনুভব আজ অবধি বিদ্যমান। সেকালে শিশুরা অর্থাৎ যাদের বয়স আট দশ বছর ছিল, তাদের মধ্যে রোজা রাখার ভীষণ রকমের প্রতিযোগিতা ছিল। এ যুগের ছেলে-মেয়েরাও হয়তো এমনটাই করে থাকে! তবে সেই প্রতিযোগিতার ধরন ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। সে সময় সকালে সাবান দিয়ে গোসল করে বাড়িতে সেমাই খেয়ে টুপি মাথায় পুরাতন জামা, ছেঁড়া লুঙ্গি এক জোড়া স্যান্ডেল পরে মহা আনন্দে ঈদগাহে নামাজ পড়তে যেতাম আমরা। নামাজের পর একে অপরকে জড়িয়ে প্রাণ খুলে কোলাকুলি করতাম। ছোটোরা মুরুব্বিদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতো। সে সময় সালাম করলে মুরুব্বিরা সালামী হিসেবে কোনো টাকা দিতো না। তারা বরং মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করতো। পক্ষান্তরে এ যুগের ছেলে-মেয়েদের সালামের উদ্দেশ্যই টাকা পাওয়া, কোনো দোয়া নয়! সে সময় মহাআনন্দে একসাথে সবাই মিলেমিশে এবাড়ি-ওবাড়ি সেমাই খেতে যাওয়ার ভীষণ প্রতিযোগিতা ছিলো। সৃজনশীল বিষয়ের প্রতি আমাদের আগ্রহ ছিলো সহজাত। আর এ বিষয়গুলোই আমাদের জীবনকে ছোটোদের স্নেহ, বড়দের শ্রদ্ধা সম্মান করবার ক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়েছে বলে আমার ধারণা। আবার বলতে পারি, এখনকার সময়ে সেই কালচার নেই বললেই চলে, হয়তো বা দু’এক বাড়িতে যাওয়া হয়। আমাদের সময় যেভাবে দলবেঁধে যাওয়া হতো, তা সময়ের গহ্বরে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তখনকার সময়ে ঘরে ঘরে ফিরনি-সেমাই রান্না হতো তা বন্ধু বান্ধবদের ডেকে এনে সবাই মিলে একত্রে খেতো। বর্তমান প্রেক্ষাপট এমন একটা জায়গায় আমরা এসে দাঁড়িয়েছি যদিও ঘরে ঘরে এখনও সেমাই-পায়েশ ও মাংস পোলাও রান্না হয় কিন্তু দেখা যায় আগের মত কেউ কাউকে ডেকে এনে আপ্যায়ন করায় না। গ্রামের বাড়িতে হয়তো দুই একজন আত্মীয়-স্বজন একে অপরের বাড়িতে যায়, শহরে একেবারে নেই বললেই চলে। আমাদের সময়ের ঈদের আনন্দ এখনও হৃদয়ের মাঝে দোলা দিয়ে যায়, তা লিখে প্রকাশ করার সম্ভাবনা। সে যুগের শিশুরা বিকেল হলেই বিভিন্ন খেলাধূলায় মেতে উঠতো, আর বয়স্করা তাঁদের উৎসাহিত করতো। বড়রা গোল হয়ে বসে একে অন্যের খোঁজ নিতেন এবং নানা গল্প-গুজবে মেতে উঠতেন। সেকালের শিশু-কিশোরদের শুধু পড়াশোনা করাই শৈশবের মূল বিষয় ছিলো না। পক্ষান্তরে এ যুগের বাচ্চাদের পড়ালেখাই হলো মূল বিষয়, যার কারণে বাচ্চারা বড্ড ক্লান্ত আর যান্ত্রিক। আর বয়স্করা বেলকনিতে বসে অপেক্ষা করে অজানা কোনো পথে পাড়ি দিবার উসিলা!
সেকালের ধনি-দরিদ্রের মধ্যে আজকের মতো এতো ভেদাভেদ ছিল না। ধনি এবং দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধানও ছিল কম। আর আজ? তা কতোটা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে, যা চোখ মেললেই সহজেই অবলোকন করা যায়। এর সাথে মানবতা-মূল্যবোধ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে বলা চলে। গরিবের ঘরের খবর ধনিরা রাখেন না। ঈদ আসলে নামে মাত্র যাকাত-ফেতরা দিয়ে দায়িত্ব ও মানবতাবোধ শেষ বা কোনো ক্ষেত্রে তাও আবার দাম্ভিকতার পর্যায়ভুক্ত। মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষের নুন আনতে এখনও বেশির ভাগ মানুষের পান্তা ফুরায়। ছেলে-মেয়েদের চাহিদা মিটাতে হিমশিম খেতে হয়। রীতিমতো নিতান্ত প্রয়োজন মনে করেই যা না হলেই নয়, তা অর্জনও কঠিন হয়ে পড়েছে অনেকের জন্য! যাদের পক্ষে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই দুষ্কর, তারা এই চাপ বইবে কেমন করে? উচ্চবিত্ত পরিবারের তো কথাই নাই, তাদের বেশির ভাগই রমজান শুরুর প্রাক্কালেই সব কেনাকাটা শেষ করে ব্যস্ত থাকেন শেষ সময়ে মুদি বাজার করতে। অথচ নিম্নবিত্ত পরিবার এবং খেটে খাওয়া মানুষগুলো তাদের বাচ্চাদের নতুন পোশাক দিতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেকে পারে না ঈদের দিন ঘর থেকে বের হতে। মানবেতর জীবনযাপন তাদের। ঈদে নতুন জামার ইচ্ছে দূরে থাক, ভালো কিছু খাবারের প্রত্যাশাও তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। বলা বাহুল্য ঈদ বড়লোকের জন্য আনন্দ আর গরীবের জন্য বেদনাদায়ক ও যন্ত্রণার। যেমন অর্থনৈতিক বৈষম্য, জীবনমানের বৈষম্য প্রকট। আমরা দেখি কোনো কোনো মানুষের গাড়ি-বাড়ি বিলাসবহুল জীবন। নানা গল্প শুনি, অমুক শিল্পপতির এতগুলো কারখানা, কোটি-কোটি টাকা আয়, যার শুধু দেশেই নয় বিদেশেও গাড়ি-বাড়ি। তারা এদেশের গরিব মানুষের মেহনতের ফসল বিদেশে পাচার করে। এদেশের টাকা দিয়ে বিদেশে মার্কেটিং করে। তারা অসুখ হলে এদেশে চিকিৎসা করে না, বিদেশে চিকিৎসা করেন। এমন আরো অনেক ঘটনা দৃশ্যমান। তবে অতিরিক্ত বিলাসী পোশাক না পরে সমাজের দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর এখনই সময়। কারণ উঁচু-নিচুর ভেদ প্রকট হলে সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি হয় এবং এর প্রভাবে সমাজের সাম্য ব্যহত হয়ে বৈষম্যের আগুনে জ্বলে উঠতে পারে। যার দায় নিশ্চিত বিত্তবান ও প্রশাসনের।
মাহে রমজানে আমাদের শিক্ষা হলো গরিব-দুঃখি মানুষের কষ্টের বোঝা হাল্কা করার। অনেক হতদরিদ্র মানুষ আছে যাদের কাছে ঈদ বিষাদ ভরা যন্ত্রণার। তাদের কেনাকাটা দূরে থাক, ঈদের দিন ভালো কিছু খেতে পারবেন কি না, সেটাও জানেন না। তাদের পাশে বিত্তশালীদের এগিয়ে আসাই হলো নৈতিক দায়িত্ব। ঈদের আনন্দে গা ভাসিয়ে না দিয়ে, বিত্তের একটা অংশ গরিব কর্মহীন অসহায় মানুষের জন্য খরচ করা ধনিদের ব্রত হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমাদের ধর্মীয় আদর্শ, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির খোলামেলা বাহ্যিকরূপ ঈদের প্রাক্কালে প্রত্যক্ষ করা জরুরি। এতেই ঈদের আনন্দ সকল মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে। ক্ষুধা-দারিদ্র্য কারো জীবনের ঈদ আনন্দ কেড়ে নিবে না। তবে আমাদের আত্মপরিচয় বা জাতিসত্তা ঈদের প্রাক্কালেই শুধু নয়, সবসময় থাকা উচিত। ঈদ হোক সবার জন্য আনন্দের। সকল মানুষের প্রত্যেকটি ঈদ যেন হয় আনন্দের। তাহলে গরিবের ঈদ যন্ত্রণার লাঘব হবে। মনে রাখতে হবে ঈদ আমাদের আনন্দের এবং সুখের উৎসব। যা সার্বজনীনতায় ভরে উঠুক সবার আন্তরিকতায়। আমরা মৃত্যুকে স্মরণ রাখি। মৃত্যু কখনো ধনি-দরিদ্র, ছোট-বড়, রাজা-প্রজা ও মনিব-ভৃত্যের মাঝে পার্থক্য করে না।
Leave a Reply