এস এম রফিকুল ইসলামঃ সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের পঞ্চপান্ডবের তাণ্ডবে আওয়ামী লীগের পুরোটা সময় তটস্থ ছিল স্হানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। টেন্ডারবাজি,প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ,নির্বাহী প্রকৌশলী বদলীসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা কর্মচারী বদলী এবং নানাভাবে হয়রানি করাই ছিল তাদের কাজ। এসব অনৈতিক কাজে নেতৃত্ব দিতেন মন্ত্রীর ভাতিজা সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম ও যুবলীগ নেতা শাহাদাত হোসেন, ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) মো. কামাল হোসেন, সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) জাহিদ হোসেন ও মন্ত্রীর শ্যালক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহব্বত আলী। এসব অপকর্মের মূল সোর্স ছিলেন এলজিইডির ইউজিপ প্রকল্পের বর্তমান প্রকল্প পরিচালক বারেক। তিনি এপিএস জাহিদসহ আলোচনা করে পরামর্শ দিতেন কোন প্রকল্পে পরিচালক নিয়োগ করতে কত টাকা নেয়া যায়।কোন জেলায় নির্বাহী প্রকৌশলী বদলী করলে কত টাকা নিতে হবে। উল্লেখ্য বারেক কুমিল্লা জেলা এলজিইডির সি,সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে দীর্ঘদিন থাকার ফলে সাবেক মন্ত্রী তাজুল এবং তাঁর সিন্ডিকেটের সাথে তাঁর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে।সেই সুবাদে বারেক মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে গাজীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।পরবর্তীকালে তাজুল সিন্ডিকেটের সাথে এলজিইডির বিভিন্ন প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ থেকে শুরু করে নির্বাহী প্রকৌশলী বদলীর টাকার অংক বারেক নির্ধারন করে দিতেন।যার সুবাদে জুনিয়র হওয়া সত্বেও গ্রেডেশন তালিকায় সিনিয়রদের বাদ দিয়ে তাঁকে তাজুল সিন্ডিকেট ইউজিপ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সদর দপ্তরে তাঁদের শক্তি বৃদ্ধি করে। এসকল অনৈতিক কাজ করে তারা এখন বিশাল সম্পদের মালিক। তবে গত ৫ আগস্টের পর থেকে এই জুলুমবাজদের আর প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছেনা।মন্ত্রণালয় চালাতেন তার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) জাহিদ হোসেন ও ভাতিজা আমিরুল ইসলাম। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি, টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্য, স্থানীয় সরকার পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে অর্থ বরাদ্দ, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত কিংবা প্রত্যাহার সবকিছু হতো তাদের ইশারায়। বড় বড় আমলাও ছিলেন তাদের ভয়ে তটস্থ। মন্ত্রী নিয়মিত সচিবালয়ে না গেলেও তারা অফিস করতেন নিয়মিত। মন্ত্রী তাজুল ইসলাম হলেও মন্ত্রণালয় পরিচালনা করতেন এই ‘ছায়া’ দুই মন্ত্রী।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পটপরিবর্তন হওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তারা বলছেন, এপিএস জাহিদ ও ভাতিজা ছায়ামন্ত্রী হিসেবে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। সবকিছু ছিল তাদের কবজায়। ভাতিজা ও এপিএসের সঙ্গে দেখা না করে মন্ত্রীর কাছে গেলে কোনো কাজ হতো না। মন্ত্রী নিজেই জিজ্ঞেস করতেন তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে কি না। এ সুযোগে তারা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পরিষদ, পৌরসভার প্রকল্প গ্রহণ, টেন্ডার ও ঠিকাদার নিয়োগ করতেন ভাতিজা ও এপিএস। একই সঙ্গে এসব সংস্থার কর্মকর্তাদের বদলি, থোক বরাদ্দ গ্রহণ, বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণসহ সব কার্যক্রমই মূলত তাদের দুজনের নিয়ন্ত্রণে হতো। এসব প্রকৌশলীর বদলি হতে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিতেন তারা। আর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বদলি ও প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা রেট ধার্য ছিল। ঢাকার বনশ্রীতে তারে রয়েছে তার হাউজিং ব্যবসা। এসব করে রাতারাতি শতকোটি টাকার মালিক বনে যান তারা। এলাকাবাসীর ধারণা, ৫ আগস্টের আগে তারা দুবাইয়ে পালিয়ে গেছেন। দুবাইয়েও রয়েছে তাদের অবৈধ সম্পদ। বিদেশে পালিয়ে থাকায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
মনোহরগঞ্জের ত্রাস ভাতিজা শাহাদাত হোসেন মনোহরগঞ্জে বিগত আওয়ামী শাসনামলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ভাতিজা সাবেক যুবলীগ নেতা শাহাদাত হোসেন। এলাকায় মন্ত্রীর ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত। চাচা মন্ত্রী হওয়ায় উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ মানুষকে তুলে নিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ সম্পদের পাহাড় গড়তে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। গত ইউপি নির্বাচনে বিনা ভোটে নির্বাচিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন প্রার্থীদের কাছ থেকে জনপ্রতি পাঁচ লাখ টাকা করে মোট ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং ১১ জন চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে মোট ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা, সর্বমোট ৩৩ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে মন্ত্রীর ভাতিজা আমির। এলজিইডির প্রতিটি কাজে ১০ শতাংশ হারে কোটি কোটি চাঁদা নিতেন ওই আমির। বর্তমানে তার নামে যমুনা ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ টাকা রয়েছে। বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ৫ আগস্টের পর তাকেও এলাকায় দেখেননি স্থানীয়রা। পলাতক থাকায় তার সঙ্গেও যোগাযোগ করা যায়নি।
কুমিল্লা এলজিইডি অফিসের টেন্ডারবাজির নিয়ন্ত্রণ, ঠিকাদারি, মন্ত্রীর কমিশন বাণিজ্য এবং অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ফুলেফেঁপে উঠতে থাকেন। মাস্টার এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লাকসাম-মনোহরগঞ্জের এলজিইডির বেশিরভাগ ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিতেন তিনি। কোটি কোটি টাকার কাজ কমিশন নিয়ে সাব-কন্ট্রাক্টে বিক্রি করে দিতেন পিএস কামাল। মাত্রাতিরিক্ত অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে দুদক কামালের বিরুদ্ধে মামলাও করে। ৯ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর দুদক কুমিল্লার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক পাপন কুমার সাহা বাদী হয়ে মামলাটি করেন। দুদকের অনুসন্ধানে তার নিজ নামে স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে ১৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৯ হাজার ২৫৫ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। দুদক সূত্র জানায়, তার পারিবারিক ব্যয়, পরিশোধিত কর ও অপরিশোধিত দায়সহ ১৭ কোটি ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ২৬ টাকার নিট সম্পদ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৮ কোটি ২০ লাখ ২১ হাজার ৮০ টাকার সম্পদের বৈধ উৎস পাওয়া গেছে। আর ৮ কোটি ৯৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯৪৬ টাকার সম্পদের কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি।
কামালের বিপুল সম্পদের সিকিভাগও দুদকের তদন্তে আসেনি। তার কুমিল্লার হাউজিং এস্টেটে একাধিক বাড়ি, কান্দিরপাড় এলাকায় বিগ বাজার সুপার মার্কেট, একই এলাকায় অনেক ফ্ল্যাট, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও প্লট এবং কৃষি ও অকৃষি জমির তথ্য বের করতে পারেনি দুদক। স্থানীয়রা জানান, শুধু কুমিল্লা শহরেই কামালের ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকার বেশি। তারা তার এসব অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানিয়েছেন। মনোহরগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, কামাল কৃষকের ছেলে। ঠিক মতো খেতেও পারতেন না। তিনি এখন কয়েকশ কোটি টাকার মালিক। দুদক তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করলেও সম্পদের সিকিভাগও বের করতে পারেনি। তার দৃশ্যমান কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।
মো. তাজুল ইসলাম এলজিআরডি মন্ত্রী থাকাকালে সাড়ে পাঁচ বছর শুধু কুমিল্লায় ডিপিএইচইর হাজার কোটি টাকার কাজ হয়েছে। প্রতিটি কাজের ঠিকাদার নিয়োগ দিতেন কামাল। প্রতিটি কাজ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নিতেন। আর এর সহযোগী ছিলেন ডিপিএইচই কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ। তিনিও নামে-বেনামে প্লট, ফ্ল্যাটসহ কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। অভিযোগ রয়েছে, ২০২২ সালের ২৬ জুলাই কার্যাদেশ দেওয়া কাজ মাত্র চার দিনে অর্থাৎ ৩০ জুলাই শেষ হয়ে যায়। আড়াই কোটি টাকার এ কাজ সম্পন্ন ও চূড়ান্ত বিল প্রদানের মতো হরিলুট করেছেন এ কর্মকর্তা ও মন্ত্রীর সহচর কামাল।
Leave a Reply