1. masudkhan89@yahoo.com : Ghoshana Desk :
  2. zunayedafif18@gmail.com : Mahir Al Mahbub : Mahir Al Mahbub
  3. masudkhan89@gmail.com : Masud Khan : Masud Khan
কবি ও গল্পকার মো. বেল্লাল হাওলাদার-এর লেখা ‘স্মৃতিরা অমলিন’ - দৈনিক ঘোষণা
ব্রেকিং নিউজ :
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম যাবে চীনের বাজারে, খুশি চাষিরা নওগাঁয় ১৭১৯ কেজি সরকারি চাল জব্দ অবৈধ অভিবাসন রোধ ও পুলিশের সামর্থ্য বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করবে ইতালি- স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নওগাঁয় সড়ক দূর্ঘটনায় দু’জন শিক্ষার্থী’র মৃত্যু পীরগঞ্জে রাস্তা সংস্কার কাজের ঠিকাদারী পেলেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলাকারী পলাতক আ’লীগ নেতা! কেসিসির নির্বাচনের ফলাফল বাতিল চেয়ে মঞ্জুর করা মামলার শুনানি ৪ মে। বাবা-মেয়েকে অপহরণ করে নির্যাতনের দায়ে চাচা-ভাতিজার বিরুদ্ধে মামলা, প্রাণনাশের হুমকিতে পরিবার পলাশ উপজেলা বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা না করতে পেরে অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি মহল। শিশুদের সাথে সব সময় ইতিবাচক আচরন করতে হবে, কেএমপি পুলিশ কমিশনার। গফরগাঁওয়ে প্রবাসীর স্ত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

কবি ও গল্পকার মো. বেল্লাল হাওলাদার-এর লেখা ‘স্মৃতিরা অমলিন’

  • আপডেট সময় : সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪
  • ৩২১ দেখেছেন

সমুদ্র তীরে হাঁটতে হাঁটতে পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে যায় বালু কণারা। আমার হৃদয়ের পরতে পরতে ভীষণভাবে ভাসে আমার মা। যিনি কি’না বেশ কয়েক বছর আগে ছেলে-মেয়ে সহ অসংখ্য নাতি-নাতনীদের ছেড়ে এই পৃথিবীর মায়া মমতা ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আমার জীবনের প্রতিটি আনন্দক্ষণে ভেসে ওঠে মায়ের স্পষ্ট ছবি, তখন বিষণ্নতার বোবাকান্নায় হাহাকার করে উঠে হৃদয় ও মন। সাগরের তীরঘেঁষা গাছ-গাছালি ঝাউবনের বাগান সাগরের রাক্ষসী উত্তাল ঢেউয়ের তাণ্ডবে ভেঙ্গেচুরে আজ বিলীন। বিভিন্ন রংবেরঙের পাতারা ঝরে পড়ে প্রতিনিয়ত, এই দৃশ্য দেখলে বুকের মাঝে ধরফর করে, কান্না পায়, মনে হয় এগিয়ে চলেছি মায়ের হারিয়ে যাওয়া পথ ধরে! মা ছিল আমার বেঁচে থাকার শিখর, জীবন পথে চলার অনন্য এক অনুপ্রেরণা। তার গর্ভে জন্মানোর পর আমার জীবনের এতোগুলো বছর কেটে গেছে তারই উষ্ণ-নিবিড় বুকের সান্নিধ্যে; তার স্পর্শে আমি জেগেছি, তার স্পর্শে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। বাইরের পৃথিবীকে আমি জানি না, চিনি না, আমার পৃথিবী ছিলেন আমার মা। সকালের ঘুম আগের মতো করে আর ভাঙে না! তবে মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রম হয়, সকালের সূর্য আমার আগেই উঠে যায়, আর সে সময় সূর্যের আগেই উঠতেন আমার মা, স্নেহে সুরে বাতায়নে মধুবর্ষণ হতো, বাবা উঠো, নামাজের সময় যে বয়ে যায়।

শেষ বিকেল হলেই মনটা ভীষণ ছটফট করতে থাকে, রাতের আঁধার ঘুটঘুটে অন্ধকারে হাঁটা চলা করলেই- মাকে ভীষণ মনে পড়ে। তখন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে, কারণ স্রষ্টার দরবারে বেশি বেশি দোয়া করবো মায়ের জন্য তাই বুঝি! “হাদিসে বর্ণিত সন্তানের দোয়া আল্লাহ্ কবুল করেন।” মা যখন অসুস্থ ক্যান্সারে আক্রান্ত বিছানায় শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছিল, আমিও ভীষণ ব্যথা অনুভব করছিলাম, মনে হতো আমিও মায়ের ক্যান্সারের ব্যথার অংশীদার!

মা জীবিত থাকা অবস্থায় আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয়েছে মাকে ছাড়াই। জীবন জীবিকা নির্বাহের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে চলেছি। এমনকি মহানন্দের দিন পবিত্র ঈদসহ অন্যান্য সময় কেটেছে মাকে ছাড়া। একটা সময় ছিল যোগাযোগের কোনো মাধ্যম ছিল না। দেশ তখনও তথ্য প্রযুক্তির এতো উন্নত সমৃদ্ধি লাভ করেনি। সে সময় মায়ের কাছে চিঠি লিখতাম, মাসে তিন চারটা। কি লিখব বুঝতে পারতাম না। কষ্টের কথাগুলো লিখতে পারতাম না চিঠিতে। ভাবতাম আমার কষ্টের কথা শুনে মা যদি আমার জন্য কান্না করে। মায়ের কান্না ভেঁজা চোখ আমি আজো কল্পনায় দেখি।

কখনো শুনতাম না মায়ের মুখে তাঁর অপূর্ণতার ইচ্ছের কথা। আমাদের বাঙালি সমাজে আর দশটা মা যেমন হয়, উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু না থাকলেও, তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় সে আমার মা।‌ খুব সাধারণ একজন বাঙালি নারী ছিলেন। অত্যন্ত সরল সহজ সাদামাটা জীবন ছিল তাঁর। আমাদের গ্রামের সকল মানুষের মুখে এখনও শোনা যায়; তোমার মা এই এলাকায় একজন শ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন। শত কষ্টের মাঝেও সবসময় হাসিখুশি থাকতেন। আমাদের তিন ভাই ও পাঁচ বোনকে মানুষ করতে মা নিজের যত্ন নিতে ভুলে যেতেন। অনেক বড় সংসার, আমার বড় ভাই আর বাবার রোজগারে সংসারে টানাটানিতে চলতো। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল, এক সময়ে অনেক কষ্টেই দিন কেটেছে। আমাদের লেখাপড়া খরচ সংসারের খরচ, সব মিলিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে পরিবার চালাতে। মা অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন আমাদের নিয়ে। নিজে না খেয়ে ভালো খাবারটা আমাদের মুখে তুলে দিয়েছেন, কষ্ট করে জমানো টাকা ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন। নিজে ছেঁড়া কাপড় পড়ে আমাদের নতুন জামা কাপড় পরিয়েছেন। আমাদের সব ইচ্ছে মেটানোর সাধ্যমত চেষ্টা করতেন। ভাই বোনদের মধ্যে আমি ছিলাম সবার ছোট, তাই আমার সব ইচ্ছের কথা যাদুকরের মত বুঝে ফেলতেন; আমার যত অবুঝ আবদার সবই পূরণ করেছেন নেপথ্যের কারিগর হয়ে। কাউকে বুঝতে দেয়নি নিজের লুকানো কষ্ট চোখের আড়ালে রেখে, মনের আড়ালে রেখে, যত সুখ আছে সব বিলিয়ে দিয়েছে আমাদের জন্য। বিনিময়ে শেষ সময় এসেও আমাদের কাছে কিছুই চাইনি আমার মা।

তখন ছোট ছিলাম ভালো মন্দ ততটা বুঝতে পারতাম না। যখন একটু বড় হলাম ভালো মন্দ পরখ করার ক্ষমতা হয়েছে, তখন দেখলাম ধীরে ধীরে এগোচ্ছে সংসার উন্নতির দিকে। তখন মায়েরও কষ্টের কিছুটা লাঘব হতে শুরু করলো, ঠিক তখনই আমার মেজো ভাই জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে ১৫ বছর বয়সে মারা যান। ঐ সময় চিকিৎসাসেবার এতোটা উন্নতি হয়নি। জন্ডিস ধরার একমাত্র কৌশল ছিল হাত-পা, চোখ হলুদ রঙ হলেই মনে করা হতো জন্ডিস হয়েছে। তখন গ্রামের ওঝা কবিরাজ দিয়ে ঝাড়ফুঁক দিলেই জন্ডিস ভালো হয়ে যেতো। আমার মেজো ভাইকে ঝাড়ফুঁক দিলেও ভালো হয়নি। মহান সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তখন ভাইয়ের শোকে মা ভেঙে পড়েন। মাকে কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে ভাইকে হারানো বেদনার শোকে।

এরপর আমার সেজো বোন দুই সন্তান রেখে মারা যান। আমার বড় ভাই ৪০/৪২ বছর বয়সে দুই সন্তান রেখে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। অনেক শোকে-দুঃখে আক্রান্ত ছিলেন মা। সন্তান হারানো বেদনায় মা আমার ভীষণ কাতর হয়ে পড়েন। জীবদ্দশায় সন্তানদের মৃত্যু পৃথিবীর কোন মা বাবাই মেনে নিতে পারেন না। সকল মা-বাবার সন্তানদের নিয়ে রঙিন স্বপ্ন দেখেন, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পান। তাই নিজেদের আগেই সন্তানের চলে যাওয়া কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারেন না, মেনে নেওয়া সহজ হয় না। আমার মা-ও মেনে নিতে পারেনি। যতদিন বেঁচে ছিলেন সবসময় বড় বড় নিশ্বাস নিতেন আর আমার প্রয়াত ভাই-বোনের কথা মনে করে অনেক কান্না করতেন। নামাজ শেষে জায়নামাজে আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে মোনাজাত ধরে হাউমাউ করে কাঁদতেন। আমরাও মায়ের সাথে কাঁদতাম। মাকে বলতাম মা আর কেঁদো না, অবুঝ মায়ের মন কী শোনে কারো বারণ? আমার বড় ভাইয়ের রেখে যাওয়া দুই সন্তান, শাহীন লাবনী ও মেজো বোনের দুই সন্তান আছিয়া ও জুয়েল এদেরকে আমাদের বাড়িতে রেখে আদর যত্ন ভালবাসায় লালন পালন করেছেন আমার মা। এদের মাঝেই আমার ভাই বোনকে খুঁজেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মা।‌ সে স্মৃতিগুলো অমলিন হয়ে বেঁচে আছে আমার হৃদয়ের মণিকোঠায়।

এরই মধ্যে আমার ধরা পড়ে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস। এটা শুনে আরো আঁতকে উঠলেন; আমাকে হারানোর ভয়ে মাকে আষ্টেপৃষ্ঠে খাচ্ছে। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহ তুমি আমার দুই ছেলেকে নিয়েছো, মেয়েকে নিয়েছে আমি ওদের হারানোর শোক বয়ে বেড়াচ্ছি। তুমি আমার ছোট ছেলেকে নিও না। ওকে তুমি ভালো করে দাও, সুস্থ করে দাও। আমার চিকিৎসার জন্য তড়িৎ গতিতে বরিশাল পাঠালেন অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন বি ভাইরাসে আমাকে ক্ষতি করতেছে। ডাক্তার ওষুধ লিখে দিলেন আর বললেন নিয়মিত ওষুধ খেতে এবং কিছু নিয়ম মেনে চলতে। ওষুধ খেলে এবং নিয়ম মেনে চললে কোনো সমস্যা হবে না সুস্থ হয়ে যাবে। ডাক্তারের নির্দেশমতো ওষুধ খাওয়ার পর আমি অনেকটা সুস্থতা অনুভব করছি। এরপর আমি যখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমার শহরে বসবাস করে মহিপুর বাজারে ব্যাবসা করছিলাম। তখন সবচেয় খুশি ও আনন্দিত হয়েছিলেন মা। বেশ গর্ব অনুভব করছিলেন তিনি।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে ব্যাবসায় অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে কয়েক লক্ষ টাকার দেনা হই। জীবন সংগ্রামের লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়ে পড়ি আমি। পাওনাদারের টাকা দিতে না পারায় এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বাড়িতে থাকাই আমার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন অনেকটাই দিশেহারা হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। তখন নিরুপায় হয়ে মা-বাবাকে ছেড়ে ব্যাবসা বন্ধ করে দিয়ে চার বছরের ছেলে রাহাত ও স্ত্রীকে নিয়ে নতুন কর্মের উদ্যেশ্য ঢাকাতে চলে আসি। তখন সবচেয়ে বেশি কষ্ট মা পেয়েছিলে, আমার কষ্টগুলো ছিলো মায়ের কাছে বিরাজমান। তারপরেও নিজের কষ্ট লুকিয়ে শুনিয়েছেন আশার বাণী। শান্তনা দিয়ে বলেছিলেন; হে বৎস আমি আল্লাহর দরবারে দোয়া করছি এই সমাজে তোমার কর্মজীবনে একদিন তুমি স্বার্থক হবে। ভেঙ্গে পড়ো না, সকল সমস্যার সমাধান হবে একদিন।
পরবর্তীতে ঢাকায় এসে মায়ের দোয়ায় কয়েকদিনের মধ্যেই গার্মেন্টেসে এইচ আর এডমিনে চাকরি পাই। মা আমাকে ও আমার স্ত্রী সন্তানের শূন্যতায় ভীষণ কষ্ট পেলেও কখনো মুখে প্রকাশ করেননি। তবে আমার মা অনেক রঙিন স্বপ্ন দেখেছিলে আমায় নিয়ে! ছেলে একদিন অনেক বড় হবে, সম্মানের সাথে পথ চলবে।
পরিবার স্ত্রী সন্তান সঙ্গে নিয়ে নীড়েই বসবাস করবে;
মায়ের কষ্ট লাঘব হবে। কিন্তু তা হলো না, মায়ের দুঃখ-কষ্ট রয়েই গেলো। মায়ের পাশে আমার অনুপস্থিতি যেনো প্রতিনিয়ত কুড়েকুড়ে খাচ্ছে।
নিত্য রাতে স্বপ্নে ডাকেছে এসো খোকা বাড়িতে,
প্রতি ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে বলছে আল্লাহর দরবারে, ভালো রেখো আল্লাহ তুমি আমার খোকাকে।

ছুটিতে মাঝেমধ্যে বাড়ি এলে মায়ের খুশির সীমা থাকত না। যখন আবার যাওয়ার সময় হতো; মা আমার বিমর্ষ ও বিষণ্ন হয়ে উঠতেন। মুখে কিছু বলতেন না। তবে তাঁর হাহাকারের দীর্ঘ নিঃশ্বাস আমি অনুভব করেছি। সে সময় আমিও ছিলাম নিরুপায়, সময়ের সাথে হাত ছিল পা বাঁধা।

মা সবসময় চিন্তিত থাকতেন আমাকে নিয়ে। কিভাবে আমার ঋণ শোধ করা যায় এবং আমাকে পুনরায় বাড়িতে নিয়ে নতুন কোনো ব্যাবসা করার ব্যবস্থা করা যায় সে চিন্তায় সব সময় মা বিভোর ছিলেন এবং চেষ্টা করেছেন অনেক। মা আমার নানার বেশ কিছু সম্পত্তি পেয়েছিলেন, সেখান থেকে কিছু অংশ বিক্রি করে আমার ঋণ পরিশোধ করেছেন, এমনকি আমার জন্য বাড়িতে একটি সেমি পাকা ঘর তুললেন। তিন চার মাস পর পর মা ঢাকাতে এসে আমার বাসায় বেশ কয়েকদিন থেকে আবার চলে যেতেন। আর বলতেন আর বেশিদিন তোমাদের ঢাকায় থাকতে হবে না, আমি সে ব্যবস্থা করে যাবো। একবার মাকে সাকুরা বাসে করে বাড়িতে পাঠিয়েছিলাম, বাবা বরিশাল এসে অপেক্ষায় ছিলেন। আমি মায়ের সাথে মাওয়ার পাড় পর্যন্ত গিয়েছি। যাতে মায়ের কোনো কষ্ট না হয়, কারণ ওই সময় আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের একমাত্র যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল মাওয়া ফেরিঘাট হয়ে যাতায়াত করা। ফেরিঘাটে সব সময় যানজট থাকতো। ফেরি পার হতে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যেতো। দীর্ঘ সময় বসে মাকে ওপারে উঠিয়ে দিয়ে আসবার সময় মা দু’গালে চুমু কপালে চুমু দিয়ে কান্না করে বললেন আর বেশি দিন তোমার কষ্ট করতে হবে না, ঢাকায় থাকতে হবে না, আমি তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাবো। এমনকি বাবাকে বলতেন, আমার একটা মাত্র ছেলে ওকে আমি কোনো ভালো ব্যবস্থা করে দিয়ে যেতে পারবো কী ? অসুস্থ শরীর নিয়ে দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকাতে অনেক কষ্ট করে চলছে। ওদের জন্য কিছু একটা করো। আমি দেখেছি মা সবসময় ভীষণ চিন্তিত থাকতো আমাকে নিয়ে, অনুভব করছি মা ব্যথিত আমার অসুখে। সকাল, দুপুর এমনকি রাতে ঘুমানোর আগে প্রায়ই মুঠোফোনে শারীরিক অবস্থা জানতে চাইতেন। কোথায় বাবা, কি করছো, ওষুধ খেয়েছো? খাবার খেয়েছি কি-না, সময়মত ঘুমিয়েছি কি-না। রাহাত, রবিউল, রোজিনা (আমার স্ত্রী) ওরা কেমন আছে.? জানিয়েছেন তার রাতের দেখা স্বপ্নের কথা, আরও কত কি! মাঝেমধ্যে আমি বিরক্ত হয়ে বলতাম, মা এতো বলো না, আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। তারপরেও মায়ের মন মানাতে পারিনি।
ভাইদের মতো আমাকে হারানোর ভয় সবসময় তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো। তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল আমার অসুখে। অথচ তাঁরও শরীরের বাসা বেঁধে আছে অদৃশ্য বি ভাইরাস নামক অসুখ। ধীরে ধীরে মাকে ঘায়েল করে ফেলেছে। হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন মা। তেমন খাওয়া-দাওয়া করতে পারেন না। খাবার খেলে হজম হয় না, পেট ভার হয়ে থাকে। তখন বাবা বরিশাল নিয়ে আসলে, ডাক্তার পরিক্ষা-নীরিক্ষা করে বললেন, ‘বি ভাইরাস’। মায়ের লিভার ক্যান্সার, এই খবর শুনে আমার বোনেরা ছুটে আসলেন বাড়িতে। মায়ের চেহারা ফুলে উঠেছে, শরীরে পানি জমেছে। বাবাও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। আমি ফোনে সবাইকে বললাম, চিন্তা করো না মাকে ঢাকায় নিয়ে এসো, ঢাকায় বড় ডাক্তার দেখালে আল্লাহ সুস্থ করে দিবেন। বাড়িতে সবার সিদ্ধান্তে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার ধানমন্ডি দি লিভার সেন্টারের প্রখ্যাত লিভার ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ মমিন খানকে দেখালাম। উনি বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখে বললেন, লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত মা, শরীরেও অনেক পানি জমেছে। লিভার অনেক শুকিয়ে গেছে আর এই রোগের রোগীরা সাধারণত বেশি দিন টিকে না। যতদিন বাঁচবে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। ডাক্তারের কথাগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। এদিকে বাড়িতে বোনেরা ভীষণ কান্নাকাটি করছে। বাবা প্রতিটি ঘন্টায় খবর নিচ্ছেন। তাঁদের শান্ত্বনা দিচ্ছি আর বলছি, চিন্তা করো না আল্লাহ মাকে সুস্থ করে দিবেন। অথচ আমি বা কি করবো, ভেবে পাচ্ছিলাম না। মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল বাবা ডাক্তার কি বলেছেন.? আমি কি সুস্থ হবো.? যদি ভালো না বলে বাড়িতে নিয়ে চলো বেশি দৌড়াদৌড়ি করো না অযথা টাকা পয়সা নষ্ট করার দরকার নেই। আল্লাহ যা করবেন তা মেনে নিতে হবে। অথচ দেখছি মা পেটে চেপে আছে, মনে হচ্ছে অনেক কষ্ট পাচ্ছে মা। আমার মা ছিলে ফুঁকনি ফোঁকা মেয়ে, ধোঁয়ার আড়ালে বেদনা ও শরীরের কষ্টের ভার একাই বইত শুধুই একা। পেটের ভেতর অনেক ব্যথা। মায়ের ব্যথায় আমিও ব্যথিত হয়ে মায়ের চোখের আড়ালে কাঁদছি। মাকে বললাম মা তুমি একটু ধৈর্য ধরো, তোমার উন্নত চিকিৎসা হবে ইনশাআল্লাহ। তুমি ভালো হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। মা আমাকে বলতেন, তুই নিজেও ঠিকঠাক মতো ওষুধ খা। না হলে অসুস্থ হয়ে পড়বি। বললাম, মা আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি ভালো আছি।

গভীর রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে মায়ের সুস্থতার জন্য দোয়া করে কান্নাকাটি করেছি। নিজের কর্মরত অফিসে না গিয়ে দিশেহারা হয়ে মায়ের রিপোর্ট নিয়ে ঢাকার বড় বড় লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে ছুটে যাই বিভিন্ন মেডিকেলে। সবাই রিপোর্ট দেখে একই কথা বললেন। পরবর্তীতে ডাঃ মমিন খানের অধীনে ধানমন্ডির আনোয়ার খান মেডিকেলে ভর্তি করালাম মাকে। সাতদিন ভর্তি রেখে বিভিন্ন পরীক্ষা করা হলো। বেশি কিছু ওষুধ দিলেন, তা খাওয়ানোর পর ধীরে ধীরে শরীরের পানি কমতে লাগলো। সেখানে চিকিৎসা করানোর পর মা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। ডাক্তার যে ওষুধ দিলেন, তা নিয়মিত খাওয়াতে বল্লেন এবং ছয় মাস পর আবার দেখা করতে বললেন। পরবর্তীতে বাড়িতে নিয়ে যাই ওষুধ খেয়ে মা বছর তিনেক খুব ভালো ছিলেন। ছয় মাস পরপর ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসি, খুব ভালো চিকিৎসা চলছিলো। পরবর্তীতে হঠাৎ করে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন, শরীর হলুদ বর্ণ হয়ে যায়। পেট শরীর ফুলে যায়। খাবার খেতে পারছিলেন না। চলাফেরাও ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল মায়ের। আমাকে ফোন করে বলেছিলেন আমার মা, ‘বাবা আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে, মনে হয় আর বাঁচবো না। ওদের নিয়ে বাড়িতে চলে আয়। আমার যদি কিছু একটা হয়ে যায়, তাহলে তোদের শেষ দেখাও দেখতে পারবো না।’ মাকে বললাম, তোমার কিছুই হবে না মা, তুমি চিন্তা করো না। তোমায় ঢাকা নিয়ে আসতেছি। বাবাকে বললাম টাকা পয়সা ম্যানেজ করে মাকে নিয়ে ঢাকায় পাঠান, দেখি আবার চিকিৎসা করে। ‌বাবা একদিনের মধ্যে টাকা ম্যানেজ করে, আমার মেজো বোন সহ মাকে নিয়ে লঞ্চে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে পাঠালেন। সেদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই আমি সদরঘাটে গিয়ে মায়ের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি। সকাল সাতটার কিছু পরে লঞ্চ এসে পৌঁছেছে। মা ও বোন লঞ্চ থেকে বের হয়ে আসলেন। মায়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। যে মা দুই মাস আগেও আমার বাসায় বেড়িয়ে গেছে। কতো সুস্থ সুন্দর শরীর ছিল মায়ের। এখন মাকে চেনাই যাচ্ছেনা। একি অবস্থা হয়েছে মায়ের। মনে কি যেন নাড়া দিলো, দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পানি পড়তে লাগলো। মা আমার চোখ মুছে দিচ্ছেন, আর বললেন, আমাকে ঢাকা না আনলেও পারতে। বাড়িতে যতদিন আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখতেন। মাকে ধরে রিক্সায় উঠিয়ে আমার ছোট বোনের বাসায় আসি। ছোট বোন ও আমার স্ত্রী মাকে দেখে হাইমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। এবার মাকে ভালো একজন লিভার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে হবে। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিলাম, এরই মধ্যে আমার এক স্কুল ফ্রেন্ড খোঁজ দিলেন যে, মিটফুড মেডিকেল কলেজের লিভার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নাসির উদ্দিন, নারায়ণগঞ্জ মেডিপ্লাস মেডিকেলে বসেন ওনাকে দেখানোর পরমর্শ দিলো, উনি নাকি বেশ ভালো চিকিৎসক। ওনার কাছে নিয়ে গেলাম মাকে। মায়ের বিগত দিনের রিপোর্ট দেখে বললেন নতুন কোনো চিকিৎসা ওনার নাই। এর আগে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এখন আপনার মাকে মেডিকেলে ভর্তি করান ওখানে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা দিয়ে দেখেন, যতদিন বিধাতা রাখেন! উনার কথামত, ওনার অধীনে মিটফুট মেডিকেলে ভর্তি করালাম। দুদিন বিভিন্ন চেকআপ করা হলো, নতুন কিছু ওষুধ দেওয়া হলো, তারপরেও শরীরের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। রাত তখন একটা বাজে মায়ের পাশে আমি আর আমার স্ত্রী। হাসপাতালের বেডে অসুস্থ মা ক্লান্ত হয়ে পড়ে আছে, তখন আমার স্ত্রীকে ডেকে মা বললেন, তোমাদেরকে আমি বাড়িতে আর ফেরাতে পারলাম না, তার আগে আমার চলে যেতে হবে। চেয়েছিলাম আমার ছেলে ও নাতিদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিবো। চিন্তা করিস না তোদের জন্য আমি দোয়া করে যাচ্ছি, আল্লাহ তোদের অনেক সুখে রাখবেন, শান্তিতে রাখবেন। মা হয়তো বুঝতে পারছিলেন তার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। মা আমাকে ডেকে বললেন, বাবা ঠিকঠাক মত ওষুধ খেয়ো, তোমারও মরণ রোগ বাসা বেঁধে আছে। কখনো ওষুধ খেতে ভুলে যেও না। আমি তো এখন মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনছি। তারপরেও মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বললেন, তুই বাসায় চলে যা বাবা, আর কত কষ্ট করবি? মাকে বললাম, আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না মা, আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ আছি তোমার দোয়ায়। আর তোমার কিছু হবে না, ডাক্তার বলেছেন, তুমি পুরো সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে। তোমার জন্য সবাই দোয়া করছেন, এভাবে ভেঙ্গে পড়ো না মা; মহান আল্লাহ সহায় আছে। দিনটা ছিল সোমবার, ডাক্তার সকালে এসে মাকে দেখে দুটো টেস্ট দিলেন, ডাক্তার বললেন টেস্ট দুটো করে রিপোর্ট আমাকে দেখাবে। মাকে হুইলচেয়ারে করে নিয়ে গেলাম মেডিকেলের নিচ তলায়। আমার স্ত্রী মায়ের হুইলচেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি চলে গেলাম মায়ের নতুন টেস্টের টাকা জমা দিতে। টাকা দিয়ে রিসিভ নিয়ে আমি খুব দ্রুত গতিতে এগোচ্ছি মায়ের দিকে। এরই মধ্যে আমার স্ত্রী ফোন দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে, কিছু বলতে পারছে না। দৌড়ে আমি চলে গেলাম মায়ের কাছে। দেখলাম মায়ের চোখ দুটো বুঝে যাচ্ছে, ঘাড়টা সোজা নেই নুয়ে পড়ছে হাত ধরে দেখলাম শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ। কি করবো দিশেহারা হয়ে দ্রুত ডাক্তার নার্সদের ডাকলাম, তারা এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, আপনার মা আর নেই।আমাদের ছেড়ে নশ্বর পৃথিবীত থেকে বিদায় নিয়েছেন! তখন কি করবো? কাকে কি বলবো? আমার শরীর সম্পূর্ণটা অচল হয়ে গেল! আমার স্ত্রীর কান্নায় পুরো মেডিকেলের মানুষ জড়ো হয়ে আমার মায়ের লাশের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তারা আমার স্ত্রীকে অনেকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আমি কাঁদতে ভুলে গেছি, আমার চোখে পানি নেই, শুকিয়ে গেছে, কন্ঠ থেকে কথা বের হচ্ছে না! আমার বোন ও দুলাভাইকে ফোন করে বললাম, দ্রুত মেডিকেলে আসতে। ওরা চলে আসলো, এসে জানলেন মা নেই। আমার স্ত্রী ও আমার বোনের কান্নায় মেডিকেলে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত গতিতে মাকে অ্যাম্বুলেন্স করে বোনের বাসায় নিয়ে আসি, পাশে মসজিদে গোসলখানায় গোসল করাই। পরে মায়ের লাশ নিয়ে বাড়ি উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম! ওদিকে বাড়িতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য মাকে হারানোর কষ্টে আমার বোনেরা ভীষণ ব্যথিত হয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। বাবাও হাউমাউ করে কাঁদছে। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে! আমার চার খালা, আমার চাচারা অন্যান্য আত্মীয়স্বজন বাড়িতে এসে জড়ো হয়েছে, সবাই শোকাহত। অবশেষে মায়ের লাশ নিয়ে বাড়িতে পৌঁছালাম। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমেই আমি কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়ি। আবার জ্ঞান ফিরলে আবার কাঁদি। কান্না থামাতে পারিনি। আমার কান্না দেখে বাড়িতে সবাই কাঁদছে। আমাকে অনেকেই সান্ত্বনা দিচ্ছে মা-বাবা তো আর চিরদিন বেঁচে থাকে না। সবারই তো যেতে হবে এই পথে। কি আর করার নিজেকে স্থির রেখে জানাজা শেষে আমার বড় ভাইয়ের পাশে মাকে দাফন করলাম। মা চিরতরে ঘুমিয়ে আছেন বাঁশ বাগানের নিচে!

আমার মা আমার জন্মদাত্রী। জানিনা, কি একটা অদৃশ্য শক্তি আমাকে বারবার কেবলই মায়ের স্মৃতিগুলোকে মনে করিয়ে দেয়। মায়ের সেই হাসি মাখা মুখ, আজও আমাকে কাঁদায়। খুব মনে পড়ে, মায়ের অনেক অনেক স্মৃতি। তখন বেশ জানতে ইচ্ছে করে….

 

কবি, সাংবাদিক ও লেখক মো. বেল্লাল হাওলাদার এবার কবিতা থেকে গল্পের জগতে প্রবেশের চেষ্টায়, তাঁর জীবন ঘনিষ্ঠ এবং চলার পথে বাস্তব ঘটনার শাব্দিক রূপে উপস্থাপিত গল্পের ডালি নিয়ে, আসছে বই মেলায় ‘প্রাণের মেলা প্রকাশনী থেকে’ প্রকাশিত হতে চলেছে প্রথম গল্পগ্রন্থ, ‘স্মৃতিরা অমলিন।’

 

 

মা তুমি কেমন আছো..?
ওই আকাশের নক্ষত্রের মাঝে
কতদিন তোমাকে দেখি না
শুনি না তোমার কন্ঠস্বর,
কতদিন কোনো স্পর্শ নেই তোমার
যেন তুমি থাকবেই যতদিন আমি থাকি
এরকমই কথা ছিলো মা।

আমার কথা কি তোমার মনে পড়ে
আমার কথা কি তুমি শুনছো না?
তোমার সাদাসিধে মুখটা
আমার বড্ড দেখতে ইচ্ছা করে,
বলো মা তোমার দেখা পাবো আমি
ওইইইইইইই আকাশে?

এখনো ঘুম ভাঙ্গে ঠিক আগের মতোই
ফজরের আজানের সুরে খুব ভোরে
শুয়ে থাকি তুমি ফোন করবে বলে,
কিন্তু তুমি আর ফোন করোনা
কীভাবে করবে! তুমি তো ভীষণ ঘুমে মগ্ন।

মা এখন আর কেউ শুধায় না
কোথায় বাবা, কি করছো, ওষুধ খেয়েছো?
কেউ শুধায় না মা, কেউ শুধায় না
খাবার খেয়েছি কিনা, সময়মত ঘুমিয়েছি কিনা।
মা রাতে ঘুম আসেনা, চোখ বুজে থাকি,
তোমার কথা খুব মনে পড়ে।

মা তুমি আমার সব ইচ্ছে মেটাতে সাধ্যমত
আর যাদুকরের মত আমার সব ইচ্ছের কথা
তুমি বুঝে ফেলতে; তোমার মত কেউ বুঝে না।
আমার যত অবুঝ আবদার সবই পূরণ করেছো
নেপথ্যে নিজে কারিগর হয়ে।
কাউকে বুঝতে দাওনি নিজের লুকানো কষ্ট
চোখের আড়ালে রেখে, মনের আড়ালে রেখে
যত সুখ আছে সব বিলিয়ে দিয়েছো
বিনিময়ে একটি মিষ্টি হাসিও তুমি পাওনি।

আজ মায়ার সংসার মিথ্যে করে দিয়ে
ঘুমিয়ে আছো একা ওই বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে।
মাঝে মাঝে ভাবি তুমি কি মানুষ ছিলে!
নাকি সংসারের খুঁটি ছিলে,
আমি তো তা-ই মনে করি।

তুমি ছিলে ফুঁকনি ফোঁকা মেয়ে,
ধোঁয়ার আড়ালে বেদনার ভার
একাই বইতে তুমি, শুধুই একা…
নিজের কষ্টে তুমি একাই কেঁদেছো
কেউ ছিলো না তোমার সংস্পর্শে।

তুমি নেই, হঠাৎ আমি টের পাচ্ছি
হাড়ে মাংসে মজ্জায়…
যখন ছিলে, তখন বুঝিনি
জানতে চাইনি কেমন ছিলে?
আমার দম্ভ চাপা পড়ে আছে
তোমার না থাকার বিশাল পাথরের তলে।

আমার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে
তা আমি কাউকে দেখাতে পারছি না
সবাই কেমন যেন নিস্তেজ-নিস্তব্ধ হয়ে গেছে,
তোমাকে ছাড়া সব কিছু হা-হা করে সবখানে
মা তোমার কাছে আমার অনেক কিছু
বলার ছিলো, কিন্তু পারিনি।

অনেক জানতে ইচ্ছে করে
মানুষ কেন মরে যায়?
কিন্তু উত্তরটা কার কাছে পাবো বলো?
কেনো আল্লাহ মানুষ তুলে নিয়ে যায় তার কাছে?
ওপারে অনেক ভালো থেকো মা
তোমার রেখে যাওয়া সন্তানগুলোর জন্য
অনেক অনেক দোয়া করো।

আমরা হয়তো অনেকেই জানি, ‘মাকড়সার ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। মা মাকড়সা, সেই ডিম নিজের দেহে বহন করে বাচ্চা বের না হওয়া পর্যন্ত। প্রকৃতির নিয়মে এক সময় ডিম ফুটতে শুরু করে। নতুন প্রাণের স্পন্দন দেখা যায় ডিমের ভেতর। কিছুদিন পর নতুন শিশুর পৃথিবীতে আগমন ঘটে, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান। কিন্তু খাদ্য কোথায়? ক্ষুধার জ্বালায় ছোট ছোট মাকড়সার বাচ্চা মায়ের দেহই খেতে শুরু করে ঠুকরে ঠুকরে! সন্তানের মুখ চেয়ে মা নিরবে হজম করে সব কষ্ট-যন্ত্রণা। এক সময় মায়ের পুরো দেহই চলে যায় সন্তানদের পেটে। মৃত মা পড়ে থাকে ছিন্নভিন্ন হয়ে, ততক্ষণে সন্তান নতুন পৃথিবীর দিকে হাঁটতে শুরু করে। এ হলো মাকড়সা মায়ের আত্মত্যাগের কাহিনী’

আমার মাও ভীষণ আত্মত্যাগী ছিলেন। নিজে ক্যান্সারে আক্রান্ত থাকা সত্ত্বেও আমি যখন ভীষণ অসুস্থ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নামক রোগে! তার অসুস্থতার কথা ভুলে আমার চিকিৎসা করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে বলতেন, হে আল্লাহ তুমি আমার সন্তানকে সুস্থ ও সুন্দর রাখো। যতো রোগ বালাই আছে আমাকে দাও, আর ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা দিও, যাতে আমার কষ্ট সন্তানেরা বুঝতে না পারে। কতটা মহান উদার ছিলেন মা। সেই মা এখন পাশে নেই, বিষয়টা ভাবতেই কেমন জানি উদাস একলা লাগে! এ আর বলার অবকাশ নেই। শূন্য হৃদয় জগৎ–সংসার এখন অন্ধকার। কিন্তু প্রকৃতির কী নির্মম পরিহাস, জন্মালে মৃত্যুবরণ করতে হবে। তাইতো আমাদের ছেড়ে, আমার সামনেই চিকিৎসারত অবস্থায় মা না ফেরার দেশে চলে গেছেন, এর চেয়ে নিদারুণ কষ্ট আর কি আছে সন্তানের কাছে.?মাকে ছাড়া আমার হৃদয় পুড়ে ছারখার, আলোতে বসেও যেন মনে হয় অন্ধকার। আর কখনো আসবেন না, বলবেন না বাবা বেলাল আছিস কেমন? ঔষুধ নিয়মিত খাও। রাহাত রবিউল ওরা কি করে.? এই পৃথিবীতে যার মা নাই, আমি তার কষ্টটা অনুভব করতে পারি। পৃথিবীতে সৌভাগ্যবান তিনি, যিনি মায়ের আদর, মায়া-মমতা ও স্নেহ-পরশে বড় হয়েছেন এবং মাকেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে মর্যাদা দিয়েছেন। আবার এমন অনেক সন্তান আছেন, যারা শিশুকালে মা হারিয়েছেন। মায়ের আদর ও স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন কিন্তু বড় হয়ে কখনো মাকে ভুলে যাননি। জীবনভর মায়ের মর্যাদাকে বক্ষে ধারণ করে ধন্য হয়েছেন। আল্লাহ সকল মাকে ভালো রাখুন দোয়া করি।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

একই রকম সংবাদ
© সকল স্বত্ব দৈনিক ঘোষণা অনলাইন ভার্শন কর্তৃক সংরক্ষিত
Site Customized By NewsTech.Com