প্রতিবেদত মোঃ বিল্লাল হোসাইন:
ভিসা প্রোসেসিং সার্ভিস সংস্থা ভিএফএস-এর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ইউরোপের শ্রমবাজার। ইউরোপে গমনেচ্ছুক লক্ষাধিক বাংলাদেশির আবেদনসহ পাসপোর্ট আটকে রেখেছে সংস্থাটি। এক থেকে দেড় বছর ধরে এসব পাসপোর্ট আটকে থাকার কারণে একদিকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে ভুক্তভোগীরা,অন্যদিকে বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীনহচ্ছে দেশ জানা গেছে,লক্ষাধিক পাসপোর্ট আটকে থাকায় এক বছরে দেশের ক্ষতি হয়েছে ৪১ হাজার ২২০ কোটি টাকা,এ অবস্থায় ভিএফএসের এমন কর্মকান্ডকে ইউরোপের শ্রমবাজার ধ্বংসে গভীর ষড়যন্ত্র বলেই মনেকরছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, ভিএফএস গ্লোবাল বাংলাদেশ নামের প্রতিষ্ঠানটিতে, দেশি-বিদেশি কর্মকর্তা- কর্মচারী কর্মরতরয়েছেন২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশে ইতালি দূতাবাস ভিএফএস গ্লোবালের সঙ্গে ভিসা প্রদানসহ যাবতীয় সেবা নির্দিষ্ট ফি-র বিপরীতে সম্পাদনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়।২০০১ সালের পর ইতালি সরকার বাংলাদেশিদের ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া বন্ধ রাখে।তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপে২০২০সালের পর থেকে বাংলাদেশিরা ওয়ার্ক পারমিটের সুযোগ পায়।এসুযোগটি গ্রহণে ইতালিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিরাঅত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দেন। ননা ২০২৩ সালের ২৭ মার্চ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইতালি সরকার বিশ্বের ২০-২২টি দেশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৮২ হাজার ৭০৫ জনকে ওয়ার্ক পারমিট দেয়।এর মধ্যে শুধু বাংলাদেশিরা পায় ৩০ হাজারেরও বেশি। ভিএফএস গ্লোবাল বাংলাদেশের মালিক নাহিদ নেওয়াজ। যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছু জানাতে চাননি।
সূত্র জানায়, ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার পর ভিসা প্রদানের সাক্ষাৎকার এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমার সিরিয়াল পেতে আবেদনকারীরা ভিএফএসের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে প্রার্থীদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্রদানে ভোগান্তি, দালাল চক্রের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাণিজ্য, লক্ষাধিক পাসপোর্ট এক থেকে দেড় বছর ধরে আটকে রাখাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করে যাচ্ছে ভিএফএস।বৈদেশিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের সঙ্গে ইন্ডিয়াসহ অন্যান্য দেশের প্রতিযোগিতা রয়েছে।
বাংলাদেশে ইতালিয়ান অ্যাম্বাসির নিয়ম অনুযায়ী ভিসার আবেদনের জন্য ভিএফএস গ্লোবালের ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। ভিএফএস গ্লোবাল গত বছর মে-র পর থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থাপনা তৈরি করছে।কোনো ব্যক্তি দালাল এবং মোটা অঙ্কের টাকা ছাড়া অ্যাপয়েন্টমেন্ট পান না।এদিকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না পেয়ে হাজার হাজার মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন।কেননা ইতালির আইন অনুযায়ী ওয়ার্ক পারমিটসহ ভিসার আবেদনপত্রটি ওয়ার্ক পারমিট বের হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে অ্যাম্বাসিতে অবশ্যই উপস্থাপন করতে হবে।
অথচ অ্যাম্বাসি সরাসরি আবেদন গ্রহণ করে না এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট জটিলতায় পড়ে অনেকেই ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ হারাচ্ছে। তাছাড়া বিগত সময়ে ওয়ার্ক পারমিটপ্রাপ্ত ৩০-৪০ হাজার আবেদনকারী পাসপোর্টসহ ভিসার আবেদন ভিএফএস গ্লোবালে জমা দিয়ে ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে অপেক্ষায় রয়েছেন। অথচ ইতালিয়ান সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আবেদন দাখিলের ২০ দিন থেকে সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে ভিসা প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ইতালিতে বাংলাদেশিদের ভালো অবস্থান এবং সুনাম থাকার পরও বর্তমানে মালিকরা বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য আবেদন করতে ইতোমধ্যেই অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশে ভিসা প্রদানের জটিলতা হচ্ছে। আমরা ওয়ার্ক পারমিট বের করে দিলেও সময়মতো শ্রমিক এখানে আসতে পারে না। আমাদের কাজের ক্ষতি হয়। অর্থাৎ ইতালির শ্রমবাজারে বাংলাদেশের সুযোগ প্রায় ধ্বংসের মুখে। এই ক্ষতি অপূরণীয়। কেননা, ইউরোপে একমাত্র ইতালিতেই দক্ষ, অদক্ষ ও নিরক্ষর লোকও গিয়ে কাজ করার জন্য আবেদন করতে পারে। এই মানুষগুলো ইতালিতে যাওয়ার সুযোগ পেলে পরিবার এবং রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে এবং সে তার জীবনমান পরিবর্তন করতে পারে।
জানা গেছে, ভিএফএস গ্লোবাল ভিসা প্রসেসিং খরচ বাবদ জনপ্রতি ১৯ হাজার ৭২০ টাকা থেকে ২২ হাজার টাকা নিয়ে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী ভিসাপ্রত্যাশীরা কাগজপত্র জমা এবং সাক্ষাৎকারের জন্য ভিএফএস গ্লোবালের নিজস্ব ওয়েবসাইটে বুকিং বা অ্যাপয়েমেন্ট গ্রহণ করে থাকে। ২০২২ সাল থেকে এ অ্যাপয়েন্টমেন্ট সহজলভ্য হলেও ২০২৩ সালের শুরুর দিকে অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য কালোবাজারি এবং ভিএফএসের যোগসাজশে একটি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। ভিসাপ্রত্যাশীরা নিজে চেষ্টা করে কোনোভাবেই ওয়েবসাইটে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারে না। ভিসাপ্রত্যাশীরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট না পেলেও ভিএফএস কমকর্তা এবং দালালদের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে সহজেই যখন-তখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট গ্রহণ করে থাকে।
সূত্র জানায়, ভিসাপ্রত্যাশীদের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য সরবরাহ করা হয় না। আবেদন গ্রহণ করার পর কোনো আপডেট তারা আবেদনকারীকে প্রদান করে না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট কবে পাবে, তাদের পাসপোর্ট এতদিন আটকে রাখার কারণ, আদৌ ভিসা সরবরাহ করা হবে কি না ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব ভিএফএস বা দূতাবাস সরবরাহ করে না। এমনকি ভিএফএসের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য খুদেবার্তা ছাড়া আর কোনো মাধ্যম নেই। ফলে মাসের পর মাস এমন দোটানায় পড়ে নাজেহাল হয় আবেদনকারী বা তার পরিবার। সূত্র মতে, ভিএফএসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট জটিলতার কারণে অনেক ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং দীর্ঘ সময় পর টাকার বিনিময়ে জমা দিলেও রিজেক্ট হয়েছে। ফলে ভিসাপ্রত্যাশীদের ১৮-২০ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে এবং টাকাগুলো আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের হাতে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে।
সরেজমিন অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, ভিএফএসের ওয়েটিং রুমে ভিসাপ্রত্যাশী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও হরহামেশা বেশকিছু দালালের বিচরণ পরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়ে ভিএফএসের জিজ্ঞাসাবাদে নিতান্তই দায়সারা গোছের জবাব পাওয়া যায়।
সূত্র জানায়, গত ৩১ মার্চ থেকে ভিএফএস মেইলিং সিস্টেমের মাধ্যমে অ্যাপয়েনমেন্ট নেওয়ার ঘোষণা দিলেও মেইলিং সিস্টেমে সিরিয়াল মেনটেনের কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। এতে একই অসংগতির পুনরাবৃত্তি ঘটে।
গত ৯ মে ভিএফএস চিটাগাং থেকে মেইলিং অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া ২০ জন আবেদনকারীর ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার কথা থাকলেও ৪০ জন মেসেজ পেয়েছেন বলে জানা যায়। যে অতিরিক্ত ২০ জন মেসেজ পেয়েছিলেন তাদের মেইলিং ডাটাবেজ চেক করে নানান ধরনের তথ্যের অসংগতি দেখা যায়। যার মধ্যে প্রধান অসংগতি হলো প্রটোকল ছাড়াই অতিরিক্ত ২০ জন অ্যাপয়েন্টমেন্টের কল পেয়েছিলেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, অফিস চলাকালীন নির্ধারিত সময়ে ভিসা স্লট ওপেনিংয়ের নিয়ম থাকলেও গভীর রাতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভিসা স্লট ওপেন করে ভিএফএস। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, ২০২২-২০২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্যদিকে শিবচর উপজেলার বহেরাতলা দক্ষিণ ইউনিয়ন সরকারের চর এলাকায় একটি মোড়ের নাম এখন ‘সিঙ্গাপুর মোড়’। কালের পরিবর্তনে এখন মাদারীপুরের অনেক যুবক মালয়েশিয়া, দুবাই, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো দেশের চেয়ে সহজেই অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে যাচ্ছেন ইউরোপে। দেখা যায় জেলার প্রতিটি উপজেলায় ইতালিপ্রবাসীদের ছড়াছড়ি। গত ৩০ বছর ধরে মাদারীপুর জেলার লোকজন আশপাশের কয়েকটি জেলার লোকজনের চেয়ে ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। দালালদের খপ্পরে পড়ে লিবিয়া দিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে প্রায়ই ঘটছে মর্মান্তিক প্রাণহানি। বর্তমানে জেলার যে কয়টি উপজেলার লোকজন ইতালি আছেন, এদের বেশির ভাগই গেছেন ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ পথে।
হাসানকান্দি গ্রামের মতিউর রহমান নামে একজন বলেন, ‘১৯৯০ সালের দিকে আতিয়ার মাতুব্বর নামে এই গ্রাম থেকে প্রথম ইতালি যান এক যুবক। তিনি গিয়েছিলেন আলমগীর ও জলিল দালালের মাধ্যমে রাশিয়া হয়ে। পরে গ্রামের বহু লোক ইতালি যান। ২০০০ সালের দিকে বাসচালকের সহকারীরা গ্রামের একটি জায়গাকে ‘ইতালি মোড়’ বলা শুরু করেন। ধীরে ধীরে সেটি ইতালি মোড় হিসেবে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে পরিচিত
শিবচর উপজেলায় বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেকে হাইস্কুলের গণ্ডি পার হতে না হতেই জন্মনিবন্ধন সনদে বয়স বাড়িয়ে চলে যান প্রবাসে। আবার কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো থাকার আশায় চলে যান প্রবাসে। গত কয়েক বছর
অবৈধভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় নৌকাডুবিতে নিহত হন। অনেকে আবার লিবিয়া দিয়ে সমুদ্রপথে পাড়ি দিয়ে চলে যান ইতালি। এসব যুবকের অধিকাংশের বয়স ৩০ বছরেরও কম। অনেকে অবৈধভাবে গেলেও তাদের ওপর ভর করে বদলে গেছে অধিকাংশের পরিবারের আর্থিক অবস্থা। ইতালিপ্রবাসী ও তাদের পরিবারের এই ভাগ্যবদল দেশটিতে যেতে আগ্রহী করেছে মাদারীপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোর যুবকসহ বিভিন্ন বয়সীদের। এই স্বপ্নকেই পুঁজি করে জেলাগুলোতে গড়ে উঠেছে ভয়ংকর মানব পাচারকারী চক্র। লিবিয়া থেকে শুরু করে জেলার গ্রাম পর্যন্ত এই চক্রের বিস্তার। এদের মধ্যে। জনপ্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টতাও পাওয়া যায়।
স্থানীয়রা জানান, এলাকার অল্প বয়সী তরুণ ও যুবকরা দালালের খপ্পরে পড়েন। পরে দালালদের প্রলোভনে ভিটেমাটি বিক্রি করে ও ধারদেনার পাশাপাশি সুদে টাকা এনেও সন্তানদের অবৈধভাবে বিদেশে পাঠান অভিভাবকরা। দুর্ঘটনায় আদরের সন্তান মারা যাওয়ায় নিঃস্ব হয়ে যায় সেই সব পরিবার। ভুক্তভোগী পরিবার সূত্র ও খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, দুর্ঘটনায় প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটলেও অবৈধপথে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা এখনো কমেনি। ফলে ভূমধ্যসাগর নৌকাডুবিতে বাড়ছে প্রাণহানি। সচ্ছল জীবনের হাতছানি আর দালালদের প্রলোভনে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার সময় সাগরে ডুবে গত ১০ বছরে মাদারীপুরের শতাধিক যুবকের প্রাণহানি ঘটেছে। নির্মম নির্যাতন সয়ে বাড়িফেরা তরুণের সংখ্যাও কম নয়। গত ১০ বছরে মাদারীপুরে ৩২৯টি মানব পাচার মামলা হয়েছে। তবে মামলার একটিরও বিচার হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ১০ বছরে তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবিতে মারা যাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন মাদারীপুরের শতাধিক যুবক। এখনো নিখোঁজ অনেকে। সর্বশেষ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তিউনিসিয়ায় নৌকায় আগুন ধরে মারা যাওয়া ৯ বাংলাদেশির মধ্যে পাঁচজনই মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বাসিন্দা। বাকি চারজনের তিনজন গোপালগঞ্জের, অন্যজন পাকিস্তানি। ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, লিবিয়ায় নিতে দালালরা প্রথমে ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা এবং ইতালি নিতে ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকায় রফা করে। তবে ‘গেম’ করানো ও হাতবদল করে কারও কারও ক্ষেত্রে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকাও আদায় করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে টাকা লেনদেনের কোনো প্রমাণ রাখে না দালালরা।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিশিয়ার ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে মারা যান মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলীর ছোট ছেলে মামুন শেখ (২২)। ওই দিন বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৭০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী নিয়ে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে তলা ফেটে ডুবে যায়। খবর পেয়ে তিউনিশিয়ার কোস্টগার্ড ভূমধ্যসাগরের তল্লাশি চালিয়ে ৫২ জনকে জীবিত এবং ৯ জনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে। ওই ৯ জনের মধ্যে একজন এই মামুন।
মামুনের মা হাফিজা বেগম বলেন, ‘আমার বাবায় কয়দিন আগে ফোন দিয়া বলে, মা তুমি চিন্তা কইরো না। আমি ইতালি পৌঁছে তোমাকে ফোন দিমু। তুমি খাওয়া-দাওয়া কইরো ঠিকমতো। আমার জন্য চিন্তা করো কেন? কিছুদিনের মধ্যে ইতালি পৌঁছে যামু।’ ছেলের বিভিন্ন স্মৃতিকথা মনে করে কেবলই বিলাপ করছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক টাকা ঋণ করছিলাম। সব মানুষের টাকা। একটু ভালো থাকার আশায় অনেক কষ্ট কইরা পোলাডারে ইতালি পাঠাইছিলাম। ভাবছিলাম, সবার ঋণ শোধ কইরা দিমু। বাড়িতে পাকা একটা ঘর তৈরি করমু। সব স্বপ্ন শ্যাষ হইয়া গেল। ওরা আমার ছেলেকে মাইরা হালাইছে, ওদের বিচার করেন। কেন ওরা আমার বুকের ধন কেড়ে নিল?’ কথা হয় মামুনের বড় ভাই সজীব শেখের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দালালরা আমার ভাইকে যে নৌকায় উঠাইছে, সেই নৌকায় ৭০ জনের মতো মানুষ ছিলেন। ওই নৌকার ধারণক্ষমতা ছিল সর্বোচ্চ ৩০-৪০ জন। বেশি মানুষকে একসঙ্গে নৌকায় ওঠানোর কারণে নৌকার তলা ফেটে গেছে। দুর্ঘটনা ঘটছে। দালালরা বেশি লাভ করতে গিয়ে এই কাজ করছে। আমার ভাইকে মাইরা ফালাইছে দালাল মোশাররফ। আমি তার বিচার চাই। আপনেরা ওর বিচার করেন। টাকাও গেল আমার ভাইও গেল। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই।’
একই দিনে অবৈধ পথে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ট্রলারডুবিতে নিহত রাজৈর উপজেলার কবিরাজপুর ইউনিয়নের কিশোরদিয়া গ্রামের মৃত তোতা খলিফার ছেলে কায়সার খলিফার স্ত্রী দুই সন্তানের জননী নাজমা আক্তারের দাবি, তার স্বামীর লাশটা যেন তারা দেখতে পান। দেশে এনে যেন তাকে দাফন করা হয়। সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিহত রাজৈরের পাইকপাড়া ইউনিয়নের দামেড়চর গ্রামের কায়সারের স্ত্রী নাজমা বেগম বলেন, ‘স্বামী আর দুই মেয়ে নিয়ে আমাদের সুখের সংসার ছিল। অভাব থাকলেও একসঙ্গে বসে খেতে পারতাম। দিন শেষে নানা সংকটেও ভালো দিন কাটত। কিন্তু দালালের খপ্পরে পড়ে আমি স্বামী হারালাম। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে অবুঝ মাদবর নামে এক দালাল আমার স্বামীকে ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। এমন স্বপ্ন সে দেখিয়েছে, আমার স্বামী মরণযাত্রী হয়েছেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১০ বছরে মাদারীপুরে ৩২৯টি মানব পাচার মামলা হয়েছে। তবে এসব মামলার একটিরও বিচার হয়নি। ফলে দালালরা দ্বিতীয়বার এমন কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। গত ১০ বছরে দালালদের খপ্পরে পড়ে মাদারীপুরের প্রায় ১০০ যুবকের মৃত্যু হয়েছে। ইতালি যাওয়ার আগে লিবিয়ায় নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে বাড়িফেরা মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
মাদারীপুর জেলা পুলিশের সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জেলায় ৩২৯টি মানব পাচারের মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি ১ হাজার ৪৬৬ জন। গ্রেপ্তার হয়েছে ২৮৭ জন। এসব মামলার মধ্যে তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ৯৬টির, চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৮৭টির, তদন্তাধীন ১০৯টি মামলা। যেসব মামলার বিচার হয়েছে, এর কোনোটিতেই কারও সাজা হয়নি। খালাস পেয়েছে ১১১ জন। বিচারাধীন রয়েছে ৬৯টি মামলা। গত ১০ বছরে অবৈধপথে ইতালি পাড়ি জমিয়েছেন ৫ হাজার ৫০০ জন।
মামলার এজাহার, ভুক্তভোগীদের স্বজনদের তথ্যমতে, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জেই অর্ধশত দালাল রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার সুন্দরদী গ্রামের মোশারফ কাজী, যুবরাজ কাজী, রাঘদী ইউনিয়নের বড়দিয়া গ্রামের ইলিয়াস, সাথী, মাদারীপুর সদর উপজেলার সুচিয়ারভাঙ্গা গ্রামের আজাদ ব্যাপারী, নয়াচর গ্রামের এমদাদ ব্যাপারী, বড়াইলবাড়ী গ্রামের রুবেল খাঁ; রাজৈর পৌরসভার গোবিন্দপুর গ্রামের মিরাজ ব্যাপারী, খালিয়া ইউনিয়নের স্বরমঙ্গল গ্রামের ওসমান গণি, শিবচর উপজেলার দত্তপাড়ার শহিদুল মাতুব্বর ও সিরাজ মাতুব্বর।
ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত সাত-আট বছরে মাদারীপুর থেকে লিবিয়া হয়ে ইতালিতে সবচেয়ে বেশি লোক গেছেন সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম মাঠ গ্রামের সুমির মাধ্যমে। তার বাবা শাখাওয়াত মাতুব্বর বছরখানেক আগে মারা গেছেন। বড় ভাইকে ইতালি পাঠাতে গিয়ে লিবিয়ায় বাংলাদেশি দালাল শরীফের সঙ্গে পরিচয় হয় সুমির। এরপর শরীফের মাধ্যমে সে অবৈধভাবে ইতালিতে লোক পাঠানো শুরু করে। লিবিয়ায় যে কজন দালাল গেমে লোক পাঠায়, তাদের একজন শরীফ। তবে শরীফের বিস্তারিত পরিচয় জানেন না কেউ। এই চক্রে লিবিয়ার নাগরিক হাইতাম ও ইসাম জড়িত। লিবিয়ায় রাজৈরের গোবিন্দপুরের মিরাজ ব্যাপারী, মুকসুদপুরের রাঘদী ইউনিয়নের ইলিয়াসসহ কয়েকজন দালাল রয়েছে। তারা স্থানীয় দালালসহ ইউপি সদস্য ও কাউন্সিলরের মাধ্যমেও টাকা লেনদেন করে বলে জানা যায়।
বক্তব্য জানতে সুমির বাড়িতে যাওয়া হলে সেখানে পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। সুমি কোথায় আছে, গ্রামের কেউ তা বলতে চাননি। তবে সুমির প্রতিবেশী আরব আলী মাতুব্বর নামে একজন বললেন, সুমিদের বাড়িতে এখন কেউ থাকে না। তারা শুনেছি ঢাকা থাকে। গ্রামবাসী জানান, সুমিদের আগে একটি ছোট টিনের ঘর ছিল, এখন সেখানে দালান তৈরি হচ্ছে। রাতারাতি তারা বড়লোক হয়েছে। শুনেছি, তারা বিদেশে লোক পাঠায়। শিরখাড়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আলী কাজী বলেন, লিবিয়ায় বিপদে পড়া লোকজনের কাছে জেনেছি, সুমি দালাল। সে নাকি ইতালি লোক পাঠায়। কেমনে কেমনে সে লোক পাঠায়, তা জানি না।
দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে ইতালি যেতে তিনবারের গেমে ১৬ লাখ টাকা খুইয়েছেন রাজৈর উপজেলার পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের মো. রাকিবুল শিকদার। তিনি জানান, একই উপজেলার মাঝিকান্দির ইতালিপ্রবাসী ওহিদুলের মাধ্যমে তিনি দুবাই হয়ে লিবিয়া গিয়েছিলেন। গেম ঘরে নিতে দালাল মিরাজের কথায় রাজৈর পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মিজানের কাছে তার পরিবার ১ লাখ টাকা দিয়েছিল। গেমে দেওয়ার পর লিবিয়ার কোস্টগার্ড আটক করে কারাগারে পাঠায়। সেখান থেকে তাকে ছাড়ানো হয়।
তবে ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান মিজান বলেন, গেম ঘরে নিতে নয়, লিবিয়ায় কারাগারে আটক রাকিবসহ কয়েকজনকে ছাড়াতে দালালকে টাকা দেওয়ার ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিলেন। তবে আর কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
মাদারীপুর সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, ঝুঁকি জেনেও অনেকে যাচ্ছেন। পরিচিতদের মাধ্যমে প্রথমে টাকা লেনদেন হয়। পরে লেনদেন হয় দালালের সঙ্গে। সমস্যা হলে তখন অনেকে মামলা করেন।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, ‘শুধু আইনের প্রয়োগ করেই দালালদের নির্মূল করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন, পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে সমাজ থেকে দালাল নির্মূল হবে। এ ছাড়া মানব পাচার মামলায় অনেক দালাল গ্রেপ্তারের পর জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও একই কাজে লিপ্ত হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুললেই এ ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হবে না।’
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান বলেন, ‘মাদারীপুরের বেশির ভাগ মানুষের অবৈধভাবে দালালের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা বেশি। আমরা বিভিন্ন সময় ক্যাম্পেইন করছি, যাতে দালালদের প্রলোভনে তারা উৎসাহিত না হন।’
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবুও তরুণরা এ পথে পা বাড়াচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের সব থেকে বেশি সচেতন হতে হবে। নয়তো এ প্রবণতা কমবে না।’
Leave a Reply