মাননীয় সংসদ সদস্য ব্যারিষ্টার সায়দুল হক সুমন সরকার থেকে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া নিয়ে কিছু সত্য কথা প্রকাশ করে দিয়েছেন। তাতে ফোস্কা পড়েছে বিরোধী দলের চীফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নুর গায়ে। কিন্তু সেই সত্য ফাঁসের গাত্রদাহের প্রত্যুত্তরে সুমন সাহেব- ধান ভানতে শিবের গীত টেনে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সম্পর্কে কিছু বেফাঁস কথা বলে ফেলেছেন। জাতীয় পার্টির অগনিত নেতা-কর্মীদের কাছে কা-চু পার্টির মহাসচিব হিসেবে পরিচিত যিনি সংসদে বিরোধী দলের চীফ হুইপের আসনকে অপবিত্র করেছেন- তার সম্পর্কে ব্যারিষ্টার সুমন এক প্রেস ব্রিফিং এ খুব সামান্যই বলেছেন। হয়তো চুন্নু সাহেব সম্পর্কে তিনি সব কিছু জানেন না। কিংবা জানলেও ভদ্রতাবসতঃ সব তথ্য ফাঁস করেননি। কিন্তু পাল্টা জবাবের মধ্যে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সম্পর্কে কিছু বেফাঁস কথা বলে- এক মণ দুধের মধ্যে সুমন সাহেব এক ফোঁটা চনা ফেলে দিয়েছেন। তা না হলে- তার প্রেস ব্রিফিং এর বক্তব্য সর্বমহলে প্রশংসিত হতো।
ব্যারিষ্টার সুমন- আপনার মতো কিছু নেতারা যখন এখনো হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে “স্বৈরাচার” বলে দেখাতে চান- দেশের মানুষের মধ্যে ক’জন তা গ্রহণ করে তা একটু যাচাই করার চেষ্টা করবেন। এরশাদ জামানার পরে যে জামানা শুরু হয়ে এখনো চলমান রয়েছে, তার মধ্যে স্বৈরাচারের রেকর্ড ভাঙ্গার প্রতিযোগিতায় কে চ্যাম্পিয়ন হলো বা হয়নি- তা দেশের মানুষের সচেতন বিবেকই বিবেচনা করুক। সুমন সাহেবের ভাষ্য অনুসারে- এরশাদ সাহেব নাকি তাঁর দলের নেতাদের টাকা কামাই করতে শিখিয়েছেন। এই মাননীয় সংসদ সদস্যকে একটু রেকর্ড খুঁজে দেখার অনুরোধ করছি। এরশাদ জামানায় যে জাতীয় বাজেট হয়েছে তার চেয়ে বেশি অর্থ তো এখন এক-একজন ঋণ খেলাপীর পকেটে রয়ে গেছে। এরশাদ আমলেই ব্যাংক বীমা বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। সে সব ব্যাংক বীমা কি একজনও জাতীয় পার্টির নেতা-মন্ত্রী-এমপি নিতে পেরেছেন? এ বিষয়ে বর্তমান সময়ের সাথে একটু তুলনা করে সঠিক তথ্যটা তুলে ধরার চেষ্টা করুণ সুমন সাহেব। তাহলে অন্তরের অন্তস্থল থেকে আপনাকে সাধুবাদ জানাবো। একটা ছোট্ট উদাহরণ এখানে তুলে ধরতে চাই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলের জাতীয় পার্টির একজন সংসদ সদস্য বর্তমানে আশ্রয়ন প্রকল্পে ভ‚মিহীনদের তালিকায় অন্তভর্‚ক্ত হয়ে একটি ঘর বরাদ্দ পেয়ে সেখানেই আশ্রয় নিয়েছেন। এর চেয়ে আর কী উৎকৃষ্ট উদাহরন দেখাতে পারি!
ব্যারিষ্টার সুমনের অজানা থাকলে জানিয়ে রাখি- মুজিবুল হক চুন্নু কিন্তু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির মূল প্রোডাক্ট নন। তিনি একজন সুযোগ্য সুযোগ সন্ধানি হিসেবে জাতীয় পার্টিতে এসেছেন ছাত্রদল থেকে। ছিলেন ছাত্রদলের ২৩ নম্বর সদস্য। সেখান থেকে এসেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দলে। এখানে এসে এমপি-উপমন্ত্রী হতে পেরেছেন। তারপর আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেছেন। আবার এসেছেন জাতীয় পার্টিতে। সবশেষ এবার তিনি এমপি হয়েছেন আওয়ামী লীগের সমর্থনে। ফলে জাতীয় পার্টির নির্ভেজাল এমপি তাকে ধরে নেয়া যায় না। তার নির্বাচনী প্রচার পোষ্টারটা দেখে নেয়া যেতে পারে। সেখানে দেখা যাবে জাতীয় পার্টির মনোনীত এবং আওয়ামী লীগের সমর্থিত একজন মুজিবুল হক চুন্নুকে। এই আওয়ামী লীগের সমর্থিত এমপি- এখন আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে বিরোধী দলীয় চীপ হুইপের আসনে বসেছেন। যে আসনে একদা বিরোধী দলের চীপ হুইপ হিসেবে মো: নাসিম বসেছিলেন- সেই আসনটি এবার অসম্মানিত হয়ে গেলো।
ব্যারিষ্টার সুমন এমপি হিসেবে যা বরাদ্দ পেয়েছেন- সেই তথ্য প্রকাশ করায় তারাগঞ্জ-করিমগঞ্জ বাসীর প্রশ্নের মুখো-মুখি হয়ে চুন্নু সাহেব সংসদে দাঁড়িয়ে মুখ রক্ষার চেষ্টা করেছেন। ৩৪৯ জন এমপির পক্ষে কথা বলে একটু বাহ্বা নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু একেবারেই বিফল চেষ্টা। একজন মাননীয় সদস্যও- টেবিলের উপর একটা টোকা দিয়েও তার কথায় সমর্থন জানালেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন কিনা- জানতে চেয়েও একটা বিরক্তি ভাবের প্রকাশ ছাড়া- আর কিছুই দেখতে পেলেন না। হায় হায় চুন্নুর কি পোড়া কপাল! মাননীয় স্পীকারকে তিনি ফেসবুক দেখাতে চেয়েছিলেন। তার বক্তব্য ফেসবুকে প্রচার হলে- যে জঘন্য ভাষার কমেন্ট এসেছে- তা দেখার পর লজ্জা-শরম থাকলে আর এভাবে কথা বলতে যাবেন না।
ব্যারিষ্টার সুমনের জন্য মুজিবুল হক চুন্নু সম্পর্কে- আরো কিছু তথ্য জানিয়ে রাখি। তিনি কিন্তু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বে আর অবস্থান করছেন না। নিয়োগ পাওয়া মহাসচিবের দায়িত্ব নিয়ে জাতীয় পার্টিকে কবরের কিনারে নিয়ে যাওয়ার জন্য- তাকে এই পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে আধা জাপা আর আধা আওয়ামী লীগ হিসেবের যোগফলে- লাঙ্গল প্রতীকের এমপি হবার কারণে- জাতীয় পার্টি তাকে একেবারেই ফেলে দিচ্ছেনা। তিনি সংসদের মধ্যেই অবস্থান করুন। হাস্যরস করার তো- একটা বিষয় লাগে। সুন্দর আসবাবপত্রে সাজানো ঘরের মধ্যেও- একটা ওয়েষ্ট পেপার বাস্কেট রাখার দরকার হয়।
সুমন সাহেব একটা যথার্থ সত্য কথা বলেছেন যে, চুন্নু সাহেব রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। শতভাগ সত্য কথা। জাতীয় পার্টি থেকে এরশাদের নাম মুছে দিয়ে- এই পার্টিকে একটি বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিনত করার জন্য জাতীয় পার্টি বিপর্যায়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। মহাজোটের প্রার্থী করার তালিকা দেখিয়ে প্রার্থীদের কাছ থেকে বিপুল হারে অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। সেই সব প্রার্থীরা এখন টাকা ফেরৎ চেয়ে বেরাচ্ছেন। মানি রিসিপ্ট ছাড়া পাওয়া টাকার কথা বলতে যাব না- জাতীয় পার্টির মনোনয়ন ফরম বিক্রির ৫ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা এবং নেতা-কর্মীদের চাঁদার টাকার কোন হিসাব নেই। তিন’শ আসনে প্রার্থী দেয়ার কথা বলে গোপনে আতাঁত করে ২৬ আসন অনুদান হিসেবে নিয়ে আসার কারিগর মুজিবুল হক চুন্নু- জাতীয় পার্টিকে ধ্বংশ করার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের নির্বাচনী পোষ্টার এবং নির্বাচনী ইশতেহার থেকে পল্লীবন্ধু এরশাদের ছবি মুছে ফেলায় দ্বাদশ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভরাডুবি হয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার- তারপরও মুজিবুল হক চুন্নু এবং তার নেতা জিএম কাদের জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের সামনে মুখ দেখাতে যায় এবং সংসদে দাঁড়িয়ে আবার কথাও বলেন!
ব্যারিস্টার সাইদুল হক সুমন ফেসবুকার হিসাবে সফল হয়েছেন। সেটা তার এলাকায় জনপ্রিয়তায় রূপান্তরিত করেছেন। কথার জাদুকর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। যত্রতত্র অনিয়ম হচ্ছে দেখাতে গিয়ে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা বিদ্যুতের খাম্বা ঠেলে নিয়ে রাস্তার উপরে উঠিয়ে ভিডিও করে প্রচার করার কথা আমরা প্রায় ভুলে যেতেই বসেছিলাম। সংসদে অল্পদিনের মধ্যে সুন্দর গঠনমূলক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখে মনে হয়েছে- আহা, ব্যারিষ্টার সুমন যদি সংসদের বিরোধীদলের নেতা হতেন- তাহলে বিরোধী দলের যে মর্যাদা থাকে, তা অন্ততঃ দেখা যেত!
আমার মতো মানুষেরা যখন সুমন সাহেব আপনাকে ভালবাসতে শুরু করেছে- ঠিক সেই সময় আপনি এদেশের অগণিত এরশাদ-প্রেমী মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কথা বলেছেন। যা বলেছেন তা কোনো কথা নয়। বলেছেন, আ-কথা, কু-কথা। যাহোক, হয়তো চুন্নু সাহেবের উপর রাগ ঝাড়তে গিয়ে তাকে পল্লীবন্ধু এরশাদের দলের নেতা মনে করে গুলিয়ে ফেলেছেন। ওই সাহেবের কু-কর্মের কথা আপনি সব ফাঁস করতে পারেননি। তবে যেটুকু বলেছেন তাতেও চলতো- যদি আপনি পল্লীবন্ধু এরশাদ সম্পর্কে অসত্য কথাগুলো না বলতেন। আশা করি, আপনি ওই কথাগুলো প্রত্যাহার করে নেবেন। ভুল স্বীকার করলে মহত্মই প্রকাশ পায়।
মনে রাখবেন সুমন সাহেব, আপনি যে সংসদে এবার প্রথম ঢুকেছেন- সেখানে অনেক আগেই আপনার চেয়ে শতগুণ বেশি জনপ্রিয়তা নিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রবেশ করেছিলেন। একটু পিছনে তাকিয়ে দেখুন, ৯০ পরবর্তী সময়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি আপনাদের বৃহত্তর সিলেটে একক দল হিসেবে নির্বাচনে সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন লাভ করেছিল। এবার কাদের- চুন্নু সাহেবরা নিজেদের স্বার্থে জাতীয় পার্টিকে গিলোটিনে দিয়ে সরকারের কাছ থেকে ২৬ টি আসন অনুদান নেয়ায় এরশাদ-প্রেমী জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা নির্বাচন থেকেই সরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ফলে পল্লীবন্ধু এরশাদের ভোট ব্যাংকের জায়গা হবিগঞ্জের জাতীয় পার্টির ভোটাররা আপনাকেই হয়তো ভোট দিয়েছেন। আপনি সেই ভোটারদের মনে কতটা আঘাত দিয়েছেন খোঁজ নিয়ে দেখবেন।
পাদটিকা: রাজনীতিতে ভালো মানুষের স্বল্পতা আছে। তাই ভালো সাজা মানুষ হিসেবে নয়- হিংসা পরায়ন না হওয়া এবং সত্যভাষী, স্পষ্টবাদী, উচিৎ বক্তা, অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী খাঁটি ভালো মানুষ হিসাবে একজন ব্যারিস্টার সুমনকে দেখতে চাই।
(সুনীল শুভ রায়: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।)
Leave a Reply