সুনীল শুভ রায়
জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশে একটি মধ্য-ডানপন্থী রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল, যেটি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৬ সালে ১ লা জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯১ সালের ৬ ডিসেম্বর, বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের কাছে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তরের পর জাতীয় পার্টি নানা ধরনের নিবর্তন, অত্যাচার ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। ওই সময়ে জেনারেল এরশাদকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হলে তিনি ১৯৯১ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারী তারিখে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের নির্বাচনের প্রচারাভিযানে অংশ নিতে পারেননি। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা নানা ধরনের হুমকি-ধমকি, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের মুখোমুখি হন। এতো কিছুর পরও দলটি ওই নির্বাচনে ৩৫ টি আসনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে আবির্ভূত হয়। এই অসম্ভব প্রাপ্তির পেছনে কাজ করেছিলো এরশাদ ম্যাজিক, যিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে ছিলেন ভালোবাসা, মমতা আর উন্নয়নের প্রতীক। দেশের অবহেলিত ৬৮,০০০ গ্রামে উন্নয়নের ছোঁয়া পৌছে দিয়েছিলেন এরশাদ। গোটা দেশ, এমনকি ঢাকা শহর ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় যখন তলিয়ে গেছে, তখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বুক পানিতে নেমে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ত্রান পৌছে দিয়েছেন – জনগনের খোঁজ খবর নিয়েছেন। এখানেই মানুষের প্রতি একজন রাষ্ট্রনায়কের খাঁটি প্রেম আর ভালোবাসার চিত্র ফুটে ওঠে।
পরবর্তীকালে, উগ্র-ইসলামপন্থী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তার মন্ত্রীপরিষদ জেনারেল এরশাদ এবং তার জাতীয় পার্টির সদস্যদের দমনের উদ্দেশ্যে দলটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা ষড়যন্ত্র করতে শুরু করেন। তৎকালীন বিএনপি সরকার জাতীয় পার্টিকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে জেনারেল এরশাদ ও দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ তুলে এরশাদকে বিচারের সম্মুখীন করে ও কারাবন্দী করে। তবে এসব দমন-পীড়নের মাঝেই এরশাদের মুক্তির দাবিতে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ আন্দোলন করতে থাকেন।
অন্যদিকে বিএনপি সরকার জাতীয় পার্টির সমর্থকদের এই বিক্ষোভ উপেক্ষা করেই এরশাদের প্রতি বর্বরতার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কারাগারের ভেতরে কয়েক ডজন নজরদারি ক্যামেরা লাগানো হয়। এমনকি এরশাদের টয়লেটেও নজরদারি ক্যামেরা বসিয়ে একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসাবে তার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে। সেসময় জেনারেল এরশাদকে অতিজরুরী চিকিৎসা সেবা হতে বঞ্চিত করে বিএনপি, যা ছিলো অমানবিক, বর্বর, পৈশাচিক, দানবীয় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ের মানবাধিকারের লঙ্ঘন। একজন স্বৈরাচারী খালেদা জিয়া এসব নির্যাতন-নিবর্তনের মাধ্যমে বাংলার মানুষের ভালোবাসার প্রতীক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে জাতীয় পার্টির নাম-চিহ্ন মুছে দেয়ার অপচেষ্টা চালান। এমন অবস্থায় দলের পতন ঠেকাতে এবং এরশাদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে জাতীয় পার্টির নিবেদিতপ্রান নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের সমন্বিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিএনপি সরকার তার দমন-পীড়ন নীতিতে অনড় ছিল।
ওই প্রতিকূলতার সময়ে, জেনারেল এরশাদ যখন কারাগারে বন্দী, তখন তার ছোট ভাই গোলাম মুহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের) তার সরকারি চাকরির সুবিধা ভোগের স্বার্থে স্পষ্টতই নীরব ছিলেন। চাউড় আছে, ওই সময়টায় জিএম কাদের বনে যান বিএনপি’র একজন একনিষ্ঠ সমর্থক। এমন কথাও শোনা যায়, সেসময় এই জিএম কাদের নিজের আপন বড়ভাই এরশাদ ও তার পত্নীর সম্পর্কে নানা কুকথা ছড়িয়েছেন। এমনকি জেনারেল এরশাদের ব্যক্তি চরিত্র নিয়েও অনেক কথাই বলেছেন এই জিএম কাদের। যাহোক, এরশাদের মুক্তির পর, তিনি তার স্ত্রী রওশন এরশাদকে দলের উত্তরসূরি হিসেবে বেছে না নিয়ে, সবাইকে হতবাক করে নিজের আপন ছোটভাই জিএম কাদেরকে বেছে নেন। আমার মতে, এটাই ছিলো এরশাদের পলিটিক্যাল সুইসাইড বা রাজনৈতিক আত্মহত্যা। এই সিদ্ধান্ত দলের সদস্যদের মাঝে চরম হতাশার জন্ম দেয় এবং জিএম কাদের-এর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির শুরুটাই ছিলো দলটির অমোঘ মৃত্যুর পূর্বাভাস। পার্টির ভবিষ্যৎ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মাঝে বিদ্যমান সন্দেহ ক্রমশ প্রকট হতে থাকে। এরশাদের মৃত্যুর পর জিএম কাদের জাতীয় পার্টিকে নিছক পারিবারিক আড়তে পরিণত করেন। বলা হয় থাকে জিএম কাদের মূলত তার স্ত্রী শেরিফা কাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত।
এরইমাঝে, জিএম কাদের দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জনের নীল নকশা বাস্তবায়নে দলের নেতা-কর্মীদের উপেক্ষা করে উগ্রইসলামীপন্থী বিএনপি এবং এর নেতা তারেক রহমানের সাথে গোপনে যোগাযোগ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাতের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এমনকি পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)-এর সাথে জিএম কাদেরের গভীর প্রেম আছে বলেও শোনা যায়। বিএনপি ও আইএসআই’র পরামর্শে জিএম কাদের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বানচালের অনেক চেষ্টাই করেছেন। এতোকিছুর পরও নির্বাচন ঠেকাতে ব্যার্থ জিএম কাদের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে রীতিমতো নির্লজ্জ ভিখারীর মতো কিছু আসন আবদার করেন। ওই আসনগুলোয় যাতে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা নিশ্চিতভাবে বিজয়ী হয় সে লক্ষ্যে আওয়ামীলীগের প্রার্থী প্রত্যাহারেরও আবদার করেন । সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হলো, জিএম কাদের তার স্ত্রী শেরিফা কাদেরকে ঢাকা-১৮ আসনটি ছেড়ে দিতে কাকুতি-মিনতী করতে থাকেন। অথচ এই শেরিফা কাদেরের নামও ঢাকা-১৮ আসনের ভোটাররা কখনও শোনেননি। এতোকিছুর পরও শেরিফা কাদের নিজের জামানত হারিয়ে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। জাতীয় পার্টি যে এগারোটা আসন পেয়েছে, এর মাঝে একটা আসন – যেখানে জিএম কাদের ‘বিজয়ী’ হন, এটা নিয়েও নানা গুঞ্জন আর হাসি-তামাশা এখনও চলছে।
সাত জানুয়ারির নির্বাচনের পর, জিএম কাদের সংসদে দাঁড়িয়েই নিজেকে গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা হিসেবে ঘোষণা দেন। একজন রাজনীতিকের কাছে এধরনের আচরণ যদিও অপ্রত্যাশিত, আমাদের মনে রাখতে হবে, জিএম কাদের মূলত রাজনীতিকের আবরণে অন্যকিছু। বাংলাদেশের গনতন্ত্রের জন্যে এধরনের ব্যক্তির উপস্থিতি দারুনভাবে ক্ষতিকর। পাশাপাশি জিএম কাদের তার নিত্য উদ্ভট আচরণের মাধ্যমে রাজনীতির ময়দানে একজন কমেডিয়ান হিসেবে এরইমাঝে স্বীকৃতি পেয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের ধারনা, জিএম কাদেরের মতো অবিশ্বস্ত ও সন্দেহজনক চরিত্র বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে বড় ধরনের হুমকি।
Leave a Reply