সালাহ্ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী
ক্রমশ রাজনীতির অংকটা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। জানিনা আমাদের রাজনীতিবিদেরা এটা উপলব্ধি করতে পারছেন কিনা। হয়তো পারছেন না। যদি পারতেন তাহলে ক্রমাগত ভুলের আয়তন প্রসারিত হচ্ছে কেনো?
পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যমে যারা সংবাদপত্র কিংবা টিভি চ্যানেলের রিপোর্টিং অথবা সম্পাদকীয় ডেস্কে কাজ করেন তারা সবাই সাংবাদিক হলেও এদের খুব সামান্যকে দেখা হয় এনালিস্ট কিংবা বিশ্লেষক হিসেবে। সাংবাদিক চোখের সামনে যা দেখেন সেটাই উপস্থাপন করেন পাঠক কিংবা দর্শকের কাছে, কখনো মেদহীন ফরম্যাটে আবার কখনো নিজেদের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের প্রলেপ মেখে। কিন্তু বিশ্লেষকদের কাজটা একেবারেই ভিন্ন। ওরা বর্তমান ও অতীতের ঘটনাপ্রবাহ মিলিয়ে অনাগত ভবিষ্যতের চিত্র তুলে ধরেন। পশ্চিমা দুনিয়ায় অন্তত বাকস্বাধীনতা আছে। একারণে বিশ্লেষকদের অনেক কথা ক্ষমতাসীনদের অপছন্দ হলেও এজন্যে তাদের ওপর রাষ্ট্রযন্ত্র খর্গ চালায় না।
কিন্তু আমাদের অবস্থাটা একেবারেই ভিন্ন।
২০০৩ সালের শুরুর দিকে আমি বিদেশের পত্রিকার নিবন্ধে লিখলাম বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলো থেকে জঙ্গিবাদের উত্থান হতে যাচ্ছে। ব্যস, আমার ওপর ক্ষেপে গেলো ক্ষমতাসীন জোট সরকারের লোকজনেরা। জামাত নেতাদের নির্দেশে বিএনপি’র হাই কমান্ড সিদ্ধান্ত নিলো আমাকে শায়েস্তা করার। এরপর আমার ওপর শুরু হয়ে গেলো রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যাচার। মামলা হলো রাষ্ট্রদ্রোহ আর ধর্মদ্রোহের অভিযোগে। অর্থাৎ, মাদ্রাসায় জঙ্গি উত্থান হচ্ছে এটা বলে আমি চরম অপরাধ করেছি। এর মাত্র দু বছর পর দেশজুড়ে যখন সিরিজ বোমা হামলা হলো কিংবা এর আগে থেকেই জাগ্রত মুসলিম জনতা যা পরবর্তীতে জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ নাম ধারণ করে অপতৎপরতা চালাতে লাগলো, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীসহ বিএনপির নেতারা বলতে শুরু করলেন, মাদ্রাসাগুলো থেকে জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে। জামাত অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটে থাকলো। মানে, আমার বিশ্লেষণ কিংবা ভবিষ্যতবাণী সত্যি হলেও বিএনপি সরকার আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যে মামলা প্রত্যাহার করলো না। স্বীকার করলো না, আমার বিরুদ্ধে মামলা দেয়াটা ভুল ছিলো।
২০০৬ সালে বিএনপি যখন নিজেদের মতো করে নির্বাচনী ছঁক সাজিয়ে আবার ক্ষমতায় থাকার পাঁয়তারা করছে এবং আওয়ামীলীগ যখন প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেছে তখন ওই বছরের অক্টোবর মাসে আল জাজিরা-কে দেয়া সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম নির্বাচন হবেনা। দেশে অন্যকিছু ঘটবে। বিএনপির কিছু নেতাকে বললাম, জেনারেল মইন ক্ষমতা নিয়ে নেবেন এবং তারেক রহমান জেলে যাবেন। আমার কথা শোনে বিএনপির নেতারা ক্ষেপে গিয়ে বললেন, “তারেক রহমান গ্রেফতার হলে লাখলাখ লোক রাস্তায় নেমে আসবে”। উত্তরে আমি তাঁদেরকে বলেছি, একটা কুকুরও ঘেউ করবেনা।
মাত্র তিনমাসের মাথায় আমার বিশ্লেষণ সত্যি হলো।
গত দু’বছর যাবত আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত ইংরেজী পত্রিকা ব্লিটজ-সহ বিদেশী বিভিন্ন পত্রিকায় আমি ক্রমাগত বলে এসেছি বিএনপি আমেরিকাসহ ইউরোপীয় দেশগুলোয় ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে এবং ওরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনপুত্র হান্টার বাইডেনকে লবিইষ্ট হিসেবে নিয়োগের চেষ্টা চালাচ্ছে। এটাও বলেছি, হান্টার বাইডেনকে হাত করতে পারলে বিএনপি বাইডেন প্রশাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর প্রবল চাপ ফেলবে।
আমার কথা কেউ পাত্তাই দেয়নি।
এরপর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে RAB-এর ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এলো। চলতি বছরের মে মাসে এলো ভয়ঙ্কর ভিসা নীতি। আমি বুঝে গেলাম, মার্কিনিরা ব্ল্যাংকেট অ্যাকশনের দিকে এগোচ্ছে।
আসন্ন নির্বাচনের দিকে ওয়াশিংটনসহ পশ্চিমা অনেক রাজধানী চোখ রাখছে। ওরা বলছে, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে হবে। মার্কিনিরা এটাও বলছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে ওরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করছে। বিএনপি যদিও তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তুলছে, আমেরিকা ওই দাবির প্রতি এখন অব্দি সমর্থন দেয়নি। এমন এক স্পর্শকাতর সময়ে হঠাৎ মাঠে উদিত হলেন মাওলানা আবেদ আলী নামের একজন। বিদেশ থেকে কয়েকজন লোক নিয়ে এসে তিনি দাবি করলেন, এরা নাকি আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক। পত্রপত্রিকায় ফলাও কভারেজ। অথচ এই লোকই ২০১৮ সালে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্যে পর্যবেক্ষক হিসেবে বিদেশ থেকে কিছু লোক নিয়ে আসেন যাদের ন্যূনতম অভিজ্ঞতা নেই। এবারও একই কান্ড ঘটালেন তিনি। কারা এই আবেদ আলীকে আবারও মাঠে নামালেন আমি জানিনা। কিন্তু এটার মাধ্যমে অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা দুনিয়াকে ভুল বার্তা দেয়া হলো। এই ঘটনায় আওয়ামীলীগের মিত্র দেশগুলোও বিব্রত।
আবেদ আলীর মতো একজন বিতর্কিত লোককে দিয়ে ঘটানো সাম্প্রতিক ঘটনার জের আমরা অক্টোবরেই উপলব্ধি করবো। ওই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রাক নির্বাচনী টিম আসবে। এরই মাঝে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক নির্বাচনী টিম বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। অক্টোবরে আমেরিকা থেকে আসা প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক টিম অনেক কিছুই খতিয়ে দেখবে। নাটকীয় মোড় নিতে পারে আগামী নির্বাচন নিয়ে ওয়াশিংটনের পলিসিতে।
এদিকে বাংলাদেশের রাজনীতি যখন পাটিগণিত-বীজগণিতের জটিল অংকে ঘুরপাক খাচ্ছে তখন আমেরিকায় বসে গোপন কোনো মতলব পাঁকাচ্ছেন বাইডেন প্রশাসনের অন্যতম খেলোয়াড় ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। ব্যক্তিগতভাবে আমি নুল্যান্ডকে বহু বছর ধরে চিনি। ভীষন ধূর্ত এই কূটনীতিক ঠান্ডা মাথায় কিভাবে একটা দেশকে অস্থিতিশীল করতে সক্ষম এর প্রমাণ আমরা পাকিস্তানে দেখছি। আরো অনেক দেশেই দেখছি।
ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতারা আগামী নির্বাচনকে যতোটা জলবৎ-তরলং ভাবছেন বাস্তবে এমনটা নয়। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে সামান্যতম ভুল আমাদের দেশের জন্যে বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে।
জানি, এবারও আমার কথা সংশ্লিষ্টরা পাত্তা দেবেন না।
সালাহ্ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, গবেষক, লেখক, কাউন্টার টেরোরিজম বিশেষজ্ঞ ও ইংরেজী পত্রিকা ব্লিটজ এর সম্পাদক।
Leave a Reply