মুজতবা আহমেদ মুরশেদ
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পী, মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল মহলানবীশের মরদেহ শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে শহীদ মিনার থেকে ফিরছি। মনটা বিষন্ন। শহীদ মিনারে বক্তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা, স্মৃতি নিয়ে বলছিলেন। আমিও ফিরে ফিরে যাচ্ছিলাম একাত্তরে। সেই একাত্তর বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের দিক নির্দেশনাায় স্বাধীনতা যুদ্ধ। লাল সবুজের পতাকায় মোড়ানো বাংলাদেশ পাওয়া। কিন্তু স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনককে মেনে নিতে পারেনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীকারিরা। এখনো তাদের প্রজন্ম, তাদের আদর্শের ধারকরা বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করার সাহস পায়।
এটা ভাবতেই বুকে একটা খোঁচা লাগলো । ভাবতে ক্রোধ হয়, কী করে সেই কালো শক্তিই সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করলো । এতটুকুই নয় , সেই কালো শক্তির দুর্বৃত্তরা পঁচাত্তরে ভাগ্যগুনে বেঁচে যাওয়া তাঁর দু’কন্যাকে এই শহরে নিজের জন্যে বাড়ি দিতেও কুণ্ঠিত। এমনকি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরলেন, তখন জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁকে বত্রিশ নম্বরের বাড়িতেও প্রবেশ করতে দেয় নি। অথচ সেই বাড়ির ভেতরে, প্রতি কোনায় শেখ হাসিনার পিতা, মাতা, ভাই আর ভাবীদের শুকনো রক্তের দাগ। রক্তের সেই দাগ ছুঁয়ে সন্তান কাঁদবে, দোয়া পাঠ করবে তারও উপায় নাই। নিষ্ঠুরতার কী বিভৎস আয়োজন!
কী অদ্ভুত! কী বিস্ময় , যার নেতৃত্বে এই বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, সেই মানুষটির সন্তানদের জন্যে এক টুকরো জমি দিতেও কুণ্ঠিত তারা!
অনেকেই ভাববেন এতো পুরোনো কাসুন্দি। এটা আবার বলার কী হলো। বলার আছে ! বারবার বলার আছে এজন্যে যে, বিএনপির এমন হীনকাজের জন্যেই রাজনীতিতে এত ফারাক। সে হলো সুত্রপাত। ভাবা যায়, কতটা মানসিক বৈকল্য বিএনপির ? সে সময়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা বাড়ি নাই। না থাক। বাড়ি পাবার অধিকার নাই তাদের?
তারপর কী হলো ? ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০১ সালের জুলাই মাসে ধানমন্ডির ৬ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাড়িটি শেখ রেহানার নামে বরাদ্দ করলে, তিনি তা নগদ মূল্যে কিনে নেন।
কিন্তু এরপর? বিএনপি-জামায়াত জোটের সইলো না। তারা ভাবলো, বঙ্গুবন্ধু বা তাঁর রক্তের কোনো অধিকার নাই বাংলাদেশের মাটিতে। সুতরাং ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসেই শেখ রেহানার নামে বরাদ্দ করা বাতিল করে বাড়িটি সরকারি মালিকানায় নিয়ে নিলো। সেখানে ধানমন্ডি থানা স্থাপন করলো। সালটা হলো ২০০৫।
কী অদ্ভুত! অথচ ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হবার পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার ঢাকা সেনানিবাসের ৬ মইনুল রোডের ১৬৮ কাঠার বিশাল বাড়িটি মাত্র এক টাকার বিনিময়ে শহীদ মইনুল সড়কের ৬নং বাড়িটি খালেদা জিয়ার নামে চিরস্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেন। সেই বরাদ্দ বহাল থাকে। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেই বাড়ির জৌলুস আরোও বাড়ায়। তাদের দিক থেকে প্রকাশিত বিষয়টা এমন ছিলো, বিএনপির নেতা খালেদা জিয়াই সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আপন। তাঁরই অধিকার আছে সামরিক বাহিনীর ক্যান্টনমেন্টের ভেতর বাস করে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেয়া।
মূলত এটা একদিকে ছিলো, বিলাশ বহুল জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষা, অনদিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, সকলকে বোঝানো বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী বিএনপি এবং খালেদা জিয়াকে ভালোবাসে।পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনীর ভয় দেখানো এবং ঐভাবে বোঝানো, জনতা সেই শক্তিকে সমীহ করে বিএনপিকে ক্ষমতায় রাখুক।
রাজনৈতিক বিবেচনায় এমন একটি অনুভব ছড়িয়ে দেয়া ও ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাজনৈতিক দল পরিচালনা করা নীতিগতভাবে বিধি সম্মত নয়। অবএব, বেগম খালেদা জিয়াকে বিধি সম্মতভাবেই ঢাকা সেনানিবাসের ৬ মইনুল রোডের ১৬৮ কাঠার বিশাল বাড়িটি থেকে সরকার সরিয়ে দেয়।
এ নিয়ে অনক চিৎকার আছে, অনেক কান্না আছে, এই বলে, কেনো খালেদা জিয়াকে ঐ বাড়ি হতে বরে করে দেয়া হলো। কিন্তু আরেকটা বিষয় নিয়ে কেউ কিছু বলে না, তা হলো , কেনো বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ রেহানার খাতে বরাদ্দ করা ধানমন্ডির ৬ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাড়িটি কেড়ে নেয়া হলো?
আমার দৃষ্টিতে এটি শুধু রাজধানীর এক টুকরো জমি থেকে বঙ্গবন্ধুর কন্যা কে উৎখাত করা ছিলো না। এটি ছিলো, সকলকে দেখিয়ে দেয়া, এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বিএনপি ও রাজাকারের দল জামায়াতে ইসলাম। সুতরাং, এখন এখানে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করো। তাঁকে অসম্মানিত করে তাঁর কন্যা শেখ রেহানাকে এ বাড়ি থেকে উৎখাত করে জনগণকে বুঝিয়ে দেয়া, এ দেশে তাদের কোনো মর্যাদা নাই।
অদ্ভুত নয় কী? এটি একটি চূড়ান্ত ঘৃণার কাজ নয় কী!তাদের ঘৃণার বিপরীতে, বিএনপি সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শেখ রেহানা হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে পড়ে ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে শেখ রেহানা ওই মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন এবং বাড়ির বরাদ্দ বাতিলের আইনি লড়াইয়ে ইতি টানার সাত মাস পর নিজের নামে থাকা জমিটি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে রেহানা হস্তান্তর করেন। আইনি লড়াইয়ে জিতেও তিনি ফিরিয়ে দিলেন সরকারের কাছ হতে পাওয়া বাড়িটি।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে বাড়িটি হস্তান্তরের সময় রেহানার বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উপস্থিত ছিলেন। হস্তান্তরের পর প্রধানমন্ত্রী হাসিমুখে বলেন, “যাক ভারমুক্ত হলাম।” হস্তান্তরের আগে শেখ রেহানা হাসতে হাসতে বলেন, “এক সরকার দেবে। আর, আরেক সরকার নেবে। আমার নামে এই সম্পত্তি থাকলে আবার মামলা দেবে। পলিটিক্স করি না। কিন্তু, মামলা খেতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে- এটাই আমার জন্য বড়। অনেক দূর চলে এসেছি। এখন সম্মানের সঙ্গে থাকতে চাই । আরও বলেন, “যখন দরকার ছিল তখন কেউ খোঁজ নেয়নি। অল্প বয়স থেকে চাকরি করে চলেছি। পড়াশোনাটা শেষ করতে পারিনি।”
এই তো হলো দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাস। এই তো হলো, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে এক করুণতম গল্প, যে গল্পে জাতির জনকের দুই দুঃখী কন্যার শুকনো অশ্রুজল মিশে আছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন শীর্ষ সংগঠক ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধুর সহপাঠি আমার পিতা অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান। তিনি ছিলেন পাকিস্তান আমলে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার নির্বাচিত সভাপতি, একাত্তরে দিনাজপুর জেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক, পশ্চিমাঞ্চল প্রশাসনিক পশ্চিম জোনের প্রধান প্রশাসক, ৭ নম্বর সেক্টর এবং ৬ নম্বর সেক্টর (অর্ধেক) এর ল্যাফটেনান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল এ্যফেয়ার্স এ্যডভাইজার, ফ্রিডমফাইটার্স রিক্রুটিং ও লিয়াঁজো অফিসার । ফলে মুক্তিযুদ্ধ ও নেতৃত্ব আমি দেখেছি খুব কাছ থেকে । একাত্তরে এগারো বছর বয়সে বালকবেলার স্মৃতি ভুলিনি এবং ভুলবোও না। যতদিন বাঁচবো, ততদিন মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামানের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধায় সালাম জানিয়ে যাবো, বঙ্গবন্ধু দু’কন্যার প্রতি ভাইয়ের মতোই ভালোবাসা জানিয়ে যাবো একান্তভাবে।
জয় বাংলা।
Leave a Reply